সিলেট ৬ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২১শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ২রা রবিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি
প্রকাশিত: ১২:৪৯ পূর্বাহ্ণ, জানুয়ারি ৬, ২০২২
খলিলুর রহমান :: মাদকের ট্যাবলেট ইয়াবা পাচারের নতুন পথ সিলেট সীমান্ত। ভারতের মিজোরাম রাজ্য থেকে আসাম ও মেঘালয়া রাজ্য হয়ে সীমান্ত দিয়ে ইয়াবা ঢুকছে সিলেটের বিভিন্ন এলাকায়। এ ছাড়া জেলার জকিগঞ্জ ও বাল্লা সীমান্তের ওপারে ভারতের কাছাড় জেলায় গড়ে উঠেছে ইয়াবা তৈরির ছোট ছোট কারখানা। সরকারী বিভিন্ন দপ্তর সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্র বলছে, দুই দেশের সীমান্তে আগে যারা হেরোইন ও ফেনসিডিল আনা-নেওয়া করত, বেশি লাভের আশায় তারা এখন ইয়াবার ব্যবসা করছে। এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে স্থানীয় কিছু রাজনৈতি নেতাকর্মী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যেরও যোগসাজশ রয়েছে। এ বিষয়ে সীমান্ত প্রহরী বিজিবির শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, ইয়াবা পাচারের জন্য ব্যবসায়ীরা এখন সিলেট সীমান্ত ব্যবহার করছে। সিলেটে ইয়াবাসহ ধরা পড়া লোকজন এসব তথ্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানিয়েছে।
সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলায় ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত রয়েছে দীর্ঘ প্রায় ৫৪ কিলোমিটার। জকিগঞ্জ সীমান্তের উল্টো দিকে ভারতের প্রাক্তন কাছাড়ের করিমগঞ্জ ও শিলচর জেলা এলাকা। দুই দেশের সীমান্তের মধ্যে রয়েছে ছোট নদী কুশিয়ারা ও আংশিক সুরমা নদী। আবার সীমান্তঘেষা কানাইঘাট উপজেলায় রয়েছে ভারতের আসাম রাজ্যের কাছাড় ও মেঘালয়া রাজ্যের দীর্ঘ পাহাড়ি স্থল সীমান্ত।
ইয়াবা ব্যবসায়ীরা নদী সীমান্ত এলকায় ওপার থেকে পলিথিন ব্যাগে ইয়াবা ভরে রশির সাহায্যে নদীতে ফেলে দেয়। এপার থেকে কারবারিরা সেটা তুলে নেয়। আবার শুকনো মওসুমে পানির কলসী বদলের মাধ্যমের চলে ইয়াবা চওে আসে। সরকারী সূত্র বলছে, ভারতের করিমগঞ্জের আবদুল্লাহপুরে ইয়াবার একটি কারখানা রয়েছে। এই কারখানায় তৈর ইয়াবা সীমন্ত দিয়ে সিরেটে এবং সিলেট থেকে দেশের অন্যান্য স্থানে পাচার হয়ে থাকে। এ পযৃন্ত ইয়াবা ও মাদক সংক্রান্ত সব চেয়ে বেশি মামলা হয়েছে সিরেটের জকিগঞ্জ ও কানাইঘাট থানায়।
পুলিশ সূত্র জানায়, জকিগঞ্জ পৌর যুবলীগের সদস্য শাহরিয়ার রহমানকে ৫০০টি ইয়াবার চালানসহ ২০১৯ সালের ২৬ এপ্রিল সিলেট নগরের দরগাহ গেট এলাকার একটি হোটেল থেকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। তৃণমূলের কয়েকজন জনপ্রতিনিধিও ইয়াবা ব্যবসায় জড়িত। তাঁদের মধ্যে জকিগঞ্জ উপজেলার খলাছড়া ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের তৎকালীন ইউপি সদস্য শাহীন আহমদ এবং ৬ নম্বর ওয়ার্ডেও তৎকালীন ইউপি সদস্য শাহাব উদ্দিনের বিরুদ্ধে ইয়াবা পাচারের ঘটনায় পৃথক মামলা রয়েছে। তাঁরা ইয়াবা মামলায় গ্রেপ্তারের পর এখন জামিনে রয়েছেন।
বিজিবির একজন কর্মকর্তা জানান, ২০১৮ সালের ১১ নভেম্বর জকিগঞ্জের মানিকপুরের সেনাপতির চক থেকে বিজিবি ৬১ হাজার ৪০০ ইয়াবা বড়ি পরিত্যক্ত অবস্থায় উদ্ধার করে। এর দুই সপ্তাহ আগে ৩ হাজার ৯০০ ইয়াবা বড়িসহ গ্রেপ্তার করা হয় একজনকে।
মাদক চোরাচালানের আরেক ট্রনজিট পয়েন্ট সিলেটের সীমান্তবর্তী কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা। উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা জুজে রয়েছে ভারতের মেঘালয়া রাজ্যেও পাহাড়ি সীমান্ত। কোম্পানীগঞ্জে মাদকও ছড়িয়ে পড়ছে মহামারীর মতোই। এমন অবস্থা যে হাত বাড়ালেই মিলছে সব ধরনের মাদক। সীমান্তের ওপার থেকে থেকে ইয়াবার পাশাপাশি ফেন্সিডিলসহ বিভিন্ন মাদক দ্রব্য বন্যার ঢলের মতো আসছে। এসব মাদক বিক্রি হচ্ছে উপজেলার বিভিন্ন স্পটে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, উপজেলার উত্তর রণিখাই ইউনিয়নের বরমসিদ্ধিপুর ও মাজর গ্রামের বাসিন্দা বিজিবির সোর্স পরিচয়দানকারী ও একাধিক মাদক মামলার আসামী কিছু যুবকই মূলত নিয়ন্ত্রণ করছে এ মাদক ব্যবসা। পরে তাদের সিন্ডিকেটের মাধ্যমে উপজেলার বিভিন্ন প্রান্তে তা বিক্রি হয়।
একটি সূত্র জানায়, সীমান্তের কাছে থাকায় সহজেই কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় ঢুকে পড়ছে ভারতীয় মদ, ফেনসিডিলসহ নানাধরনের মাদকদ্রব্য। কোম্পানীগঞ্জ থেকে এসব মাদকদ্রব্য শহর ও গ্রাম এলাকায় বিক্রি এবং সেবন করছে একটি সিন্ডিকেট। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে মাঝে মধ্যে মাদকদ্রব্যসহ ব্যবসায়ী আটক হলেও থামছে না মাদকের চোরাচালান। স্থানীয় আর একটি সূত্র জানিয়েছে, রাতের আধাঁরে ভারত থেকে বড়পুঞ্জি বাজারের রাস্তা হয়ে আনা হয় মাদকের বড় বড় চালান। এই মাদক প্রতিদিন রাতে ধুপড়িপাড় নদী দিয়ে নৌকাযোগে উপজেলার বিভিন্ন প্রান্তে যায়। এসব বড় ধরনের চালান কখনো আইনশৃংখলা বাহিনী আটক করতে না পারলেও মাঝে মধ্যে ছোট ছোট চালান আটক করে থাকেন।
উপজেলার পশ্চিম ইসলামপুর ইউনিয়নের বৃহত্তর পাড়ুয়া এলাকা, টুকেরবাজার, (চকবাজার) বউ বাজার, ভোলাগঞ্জ দয়ারবাজার, লিলাই বাজার। উত্তর রণিখাই ইউনিয়নের বতুমারা নোয়াগাও, তুরং ও সীমান্তের বড়পুঞ্জি বাজার, দক্ষিণ রণিখাই ইউনিয়নের যে সকল স্পটে মাদক বিক্রি হয় সে জায়গা হলো, সুন্দাউরা, দরাকুল, হায়দরি বাজার, খাগাইল মাদক বিক্রি ও সেবনের স্পট হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছে।
পুলিশ ও গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, ১৯৯৭ সালে দেশে প্রথম ইয়াবা নিয়ে আসে কক্সবাজারের মাদক ব্যবসায়ীরা। এরপর থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ইয়াবা পাচারের একমাত্র পথ ছিল কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের সমুদ্র এলাকা। তবে বেশির ভাগ ইয়াবা খালাস হতো কক্সবাজারের টেকনাফে। সম্প্রতি কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারি বাড়ায় সেখানে ইয়াবা খালাস কমে গেছে। ব্যবসায়ীরা বিকল্প পথ দিয়ে ইয়াবা পাচারের চেষ্টা করছে। এই তালিকায় সর্বশেষ যুক্ত হয়েছে সিলেট সীমান্ত।ইয়াবা কারবারিদের সিলেট সীমান্ত ব্যবহারের খবর ভারতের কাছেও রয়েছে। তবে আজ্ঞাতকারণে েেদও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না ভরতের আইন শৃঙ্খলা বাহিনী।
জাতিসংঘের মাদক নিয়ন্ত্রণ সংস্থা ইউএনওডিসির মতে, বাংলাদেশে উদ্ধার হওয়া মাদকের পরিসংখ্যান অনুসারে, বছরে শুধু ইয়াবা বড়িই বিক্রি হয় ৪০ কোটির বেশি, যার বাজারমূল্য প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা ।
দেশজুড়ে ইয়াবার ভয়াবহতা ছড়ানোর পর ২০১৮ সালের ৪ মে থেকে মাদকবিরোধী অভিযান শুরু করে বিভিন্ন বাহিনী। ১৫ মাসের অভিযানে বন্দুকযুদ্ধে তখন সারা দেশে ৪২৬ জন নিহত হয়েছে। তবে এসব বন্দুকযুদ্ধে মূলত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও মাদক আনা-নেওয়ার কাজে যুক্ত ব্যক্তিরাই নিহত হয়েছে। মাদক কেনাবেচার জন্য যেসব বড় বড় কারবারি গড়ে উঠেছে, তাদের খুব কমই গ্রেপ্তার হয়েছে।
মাদকের ব্যবসা ও পাচার নিয়ে গবেষণায় যুক্ত ঢাকার নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এমদাদুল হক বলেন, মাদক যদি বাজারে সহজলভ্য হয়ে থাকে, তাহলে কোনো কিছু করেই এর ব্যবহার ঠেকানো যাবে না। আর বাজার থাকলে সেটা যেকোনো পথে চলে আসবেই। তিনি বলেন, যারা মাদক কেনাবেচা করে, তারা কোনো না কোনোভাবে রাজনৈতিক সুবিধা পেয়ে থাকে। আর এ সুবিধা বন্ধ করতে হলে রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকতে হবে। তা না থাকলে ফাঁকা আওয়াজ ছাড়া কাজের কাজ কিছুই হবে না।
Sharing is caring!
………………………..
Design and developed by best-bd