সিলেট ৪ঠা অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৯শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ৩০শে রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি
প্রকাশিত: ১১:২২ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ১০, ২০২১
নিজস্ব প্রতিবেদক :: চলতি বছরের ২১ জুন সিলেট সিটি করপোরেশনের (সিসিক) সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। নগরীতে মাসিক পানির বিল বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত হয় সেই সভায়, যা কার্যকর করা হয়েছে ১ জুলাই থেকে। কিন্তু পানির বিল বৃদ্ধির বিষয়টি সিসিক গণবিজ্ঞপ্তি দিয়ে সবাইকে জানায় গত ২ সেপ্টেম্বর! এরপর থেকে বাড়তি পানির বিল ঘিরে ‘জল ঘোলা হচ্ছে’ সিলেটে। সম্প্রতি পানির বিল বৃদ্ধির প্রতিবাদে গড়ে ওঠা আন্দোলনে লেগেছে নতুন হাওয়া। করোনা পরিস্থিতিতে নানামুখী সংকটে পড়া মানুষ বাড়তি বিলের বোঝা টানতে নারাজ। সামগ্রিক সিদ্ধান্তে পানির বিল বাড়লেও নগরবাসীর ‘দোষারূপের রাডারে’ রয়েছেন সিসিক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ২ সেপ্টেম্বর সিলেটের স্থানীয় একটি পত্রিকায় পানির বিল বাড়ানোর বিষয়ে বিজ্ঞপ্তি দেয় সিটি করপোরেশন (সিসিক)। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত ১ জুলাই থেকে পানির বিল বৃদ্ধির বিষয়টি কার্যকর হয়েছে।
আবাসিক সংযোগে প্রতি মাসে আধা ইঞ্চি ডায়ামিটারের (ব্যাস) লাইনে বিল ২০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫০০ টাকা, পৌনে এক ইঞ্চি ব্যাসের লাইনে বিল ৪০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৮০০ টাকা এবং এক ইঞ্চি ব্যাসের লাইনে ১ হাজার টাকার পরিবর্তে দেড় হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়।
বাণিজ্যিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও সরকারি সংযোগে আধা ইঞ্চি ব্যাসের লাইনে মাসিক বিল ৪০০ টাকা থেকে ৮০০ টাকা, পৌনে এক ইঞ্চি ব্যাসের লাইনে ৭০০ টাকা থেকে ১২০০ টাকায় বাড়ানো হয়। এ ছাড়া, এক ইঞ্চি ব্যাসের লাইনে বাণিজ্যিক গ্রাহকদের ক্ষেত্রে মাসিক বিল দেড় হাজার পরিবর্তে ২ হাজার ২০০ টাকা, প্রাতিষ্ঠানিক গ্রাহকদের ক্ষেত্রে ২ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩ হাজার টাকা এবং সরকারি গ্রাহকদের ক্ষেত্রে ১ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে দেড় হাজার টাকা করা হয়।
সিসিকের এই সিদ্ধান্ত প্রকাশ্যে আসার পর থেকে সিলেট নগরীর সওদাগরটুলা, কাজীটুলা, চারাদিঘীরপাড়সহ বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দারা প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। মানববন্ধন, প্রতিবাদ সভা, গণসাক্ষর অভিযান চলছে একের পর এক। পানির বিল না বাড়াতে সিসিক বরাবর স্মারকলিপিও প্রদান করা হয়েছে।
সাধারণ মানুষের সাথে সাথে বিভিন্ন সংগঠনও পানির বিল বৃদ্ধির প্রতিবাদ জানাচ্ছে। সম্প্রতি জাগো সিলেট আন্দোলন নামের একটি সংগঠনের উদ্যোগে নগরীর মেন্দিবাগে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। তাঁতিপাড়া সমাজকল্যাণ সংস্থা, বিহঙ্গ তরুণ সংঘ, সওদাগরটুলা সমাজকল্যাণ সংস্থা এসব সংগঠনও পানির বিল না বাড়ানোর দাবি জানিয়ে আসছে।
পানির বিল বৃদ্ধির বিষয়টি নাড়া দিয়েছে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকেও। সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আসাদ উদ্দিন আহমদ পানির বিল না বাড়াতে সিসিকের প্রতি আহবান জানিয়েছেন। তিনি পানির বিল বাড়ানোর বিষয়টিকে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ বলে অভিহিত করেছেন।
প্রতিবাদকারীদের ভাষ্য হচ্ছে, অস্বাভাবিক হারে পানির বিল বৃদ্ধির কোনো যৌক্তিকতা থাকতে পারে না। করোনা মহামারিতে মানুষ যেখানে বিপর্যস্ত, নানাবিধ সংকটে আবর্তিত, সেখানে হুট করে পানির বাড়তি বিল মানুষের বিপদ বাড়িয়ে দিয়েছে।
জানতে চাইলে গ্যাস, বিদ্যৎ গ্রাহক কল্যাণ পরিষদের কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠাতা সদস্যসচিব মকসুদ হোসেন বলেন, ‘সিসিকের বিজ্ঞপ্তি দেখে আমরা পানির বিল বৃদ্ধির বিষয়টি জানতে পারি। পরে সিলেটের জনসংশ্লিষ্ট সংগঠন ও রাজনীতিবিদদের নিয়ে আমরা সভা করি। সবাই পানির বিল না বাড়াতে সিসিকের প্রতি আহবান জানান। সভায় সিদ্ধান্ত নিয়ে আমরা সিসিকের সচিব বিধায়ক রায় চৌধুরীর কাছে বাড়তি বিল প্রত্যাহারের দাবিতে স্মারকলিপি দেই। এরপর শুনলাম যে, বিল বাড়ানো হবে না। কিন্তু সম্প্রতি সিসিক বছরের তৃতীয় প্রান্তিকের (জুলাই-সেপ্টেম্বর) যে বিল দিয়েছে, সেখানে বর্ধিত বিলই উল্লেখ করা হয়েছে। এরপর আমরা প্রতিবাদ অব্যাহত রেখেছি।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের বক্তব্য হচ্ছে, করোনা মহামারিরি মধ্যে কাউকে না জানিয়ে, গণশুনানি না করে পানির বিল বাড়ানোর সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক এবং অমানবিক। আমরা মেয়র মহোদয়কে অনুরোধ করছি, মানবিক দিক বিবেচনা করে পানির বর্ধিত বিল প্রত্যাহার করুন। সবার সাথে পরামর্শ করুন।’ পানির বিল বৃদ্ধির প্রতিবাদে কাউন্সিলরগণকে সরব হতেও আহবান জানান মকসুদ হোসেন। পানির বিল বৃদ্ধির প্রসঙ্গে জানতে সিসিক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীকে কল দেওয়া হলে তিনি সাংবাদিকের ফোন রিসিভ করেননি। পরে সিসিকের জনসংযোগ কর্মকর্তা আব্দুল আলিম শাহকে কল দেওয়া হলে তিনিও কল রিসিভ করেননি।
সিসিকের পানি শাখার নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুস সোবহান বলেন, ‘সিসিকের সাধারণ সভায় সবার উপস্থিতিতে পানির বিল বাড়ানো হয়েছে। এখন বিল কমানো হবে কিনা, তা সিসিকের পরিষদই সিদ্ধান্ত নেবে।’
এদিকে সিলেট সিটি কর্পোরেশন (সিসিক) কর্তৃক পানির বিল অস্বাভাবিক-অযৌক্তিকভাবে বৃদ্ধির প্রতিবাদে ও বর্ধিত বিল অবিলম্বে প্রত্যাহারের দাবিতে নগরীতে মানববন্ধন ও গণস্বাক্ষর কর্মসূচিতে মহানগর আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি আসাদ উদ্দিন আহমদ বলেছেন- ‘পানির বিল না বাড়িয়ে দুর্নীতি, লুটপাত বন্ধ করতে কাজ করুন। জনগণকে ভোগান্তি দিবেন না।
জনগণ যেমন বুকে নিতে জানে, তেমনি ছুঁড়ে দিতেও জানে। নগরবাসীর মতামত উপেক্ষা করে, মানুষের সহ্যসীমার বাইরে যে পানির বিল নির্ধারণ করা হয়েছে তা অত্যন্ত অমানবিক। নগরীর অধিকাংশ কাউন্সিলরকে পাশ কাটিয়ে গিয়ে এই অস্বাভাবিক বিল নির্ধারণ করা হয়েছে বলে আমরা খোঁজ নিয়ে দেখেছি। নগরভবনের পরিষদের বৈঠকেও অফিসিয়ালি বিল বাড়ানোর সিদ্ধান্ত পাস হয়নি, তবুও বাসা-বাড়িতে বর্ধিত বিল পাঠানো হয়েছে। অবিলম্বে বর্ধিত বিল প্রত্যাহার করুন, না হলে নগরবাসীকে সাথে নিয়ে গণআন্দোলন গড়ে তোলা হবে।’
গতকাল শুক্রবার (১০ ডিসেম্বর) বেলা ২টায় নগরীর উত্তর কাজীটুলা ইলেকট্রিক সাপ্লাই রোডে এলাকাবাসীর উদ্যোগে আয়োজিত মানববন্ধন কর্মসূচিতে বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
মিসবাহ উদ্দীন আহমদের পরিচালনায় মানববন্ধন কর্মসূচিতে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন ১৭ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. রাশেদ আহমদ, সাবেক কাউন্সিলর মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ফয়জুল আনোয়ার আলাউর, উত্তর কাজীটুলা জামে মসজিদের উপদেষ্টা সাংবাদিক আব্দুল মালিক জাকা, মসজিদের উপদেষ্টা আব্দুল কাইয়ূম, মো. শাহিন আহমদ, কোষাধ্যক্ষ জয়নাল আবেদীন, সদস্য মো. শাহজাহান, রুহেল আহমদ, ব্যবসায়ী জুবের আহমদ চৌধুরী, কাজীটুলা ওয়েলফেয়ার সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক মখলিছুর রহমান বাবলু, বিএনপি নেতা কামরুল হাসান শাহিন, অন্তরঙ্গ সমাজকল্যাণ সংস্থার সভাপতি আবদুল আহাদ এলিস, সহসভাপতি সাদ উদ্দিন জাবেদ, নাদিম আহমদ সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আকবর, সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রাসেল আহমদ, কলবাখানী এলাকার মুরব্বী মো. আলতা মিয়া, আব্দুর রহিম শিপন, মো. আব্দুল হান্নান, সুরমা বয়েজ ক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মো. আনোয়ার হোসেন, ১৭ নং ওয়ার্ড যুবলীগ সাধারণ সম্পাদক তারেক আহমদ চৌধুরী, ১৭ নং ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম সৌমিক, ব্যবসায়ী মো. আশরাফুল ইসলাম।
মানববন্ধনে উত্তর কাজীটুলা, কাজীটুলা উঁচাসড়ক, কলবাখানি, রায়হোসেন কলবাখানি, ইলেকট্রিক সাপ্লাই, গোয়াইটুলা চাষনীপীর রোডের প্রায় অর্ধসহস্রাধিক মানুষ অংশ নেন।
প্রসঙ্গত, সিলেট মহানগরীতে দৈনিক পানির চাহিদা প্রায় ৮ কোটি লিটার। কিন্তু সিসিক প্রায় ৬ কোটি লিটার পানি সরবরাহ করতে সক্ষম হয়। কুশিঘাটস্থ ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট এবং নগরীর বিভিন্ন স্থানে স্থাপিত ৪২টি গভীর নলকূপের সাহায্যে পানি উত্তোলন করে সরবরাহ করা হয়।
Sharing is caring!
………………………..
Design and developed by best-bd