পিবিআই কর্মকর্তার কাণ্ড, দশ হাজার দিলে হবে না

প্রকাশিত: ১০:১৮ অপরাহ্ণ, আগস্ট ২৩, ২০২১

পিবিআই কর্মকর্তার কাণ্ড, দশ হাজার দিলে হবে না

ক্রাইম সিলেট ডেস্ক : পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) কক্সবাজার জেলা ইউনিটের এক কর্মকর্তা চট্টগ্রামে ইয়াবাসহ আটকের রেশ কাটতে না কাটতে এবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছেন একই ইউনিটের আরেক কর্মকর্তা এসআই লাভলী ফেরদৌসী।

অভিযোগ উঠেছে, মামলার তদন্তে যাওয়ার সময় এসআই লাভলী তার স্বামী মো. শাহাজাহানকে সঙ্গে নিচ্ছেন, যিনি ‘ওসির চেয়েও বড় কর্মকর্তা’ সেজে প্রভাব বিস্তার করছেন। মামলার তদন্ত রিপোর্ট এদিক-সেদিক করতে সুবিধামতো হাতিয়ে নিচ্ছেন মোটা অংকের টাকা। চাহিদামতো টাকা দিতে না পারলে বিবাদীর কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা নিয়ে রিপোর্ট বাদীর বিরুদ্ধে দেয়ার অভিযোগও প্রকাশ্যে এসেছে।

মামলার রিপোর্ট দেয়ার বিষয় নিয়ে আর্থিক লেনদেনের একটি অডিও সম্প্রতি ফাঁস হলে আলোচনায় আসেন এসআই লাভলী। এ ঘটনায় কক্সবাজারে সমালোচনার ঝড় উঠেছে।

এছাড়াও ধার নেয়া টাকা আত্মসাৎ করে প্রতারণা ও পুলিশী প্রভাব খাটিয়ে স্বামীকে দিয়ে অন্যের বসতবাড়ি দখল চেষ্টার অভিযোগ উঠেছে এসআই লাভলী ফেরদৌসীর বিরুদ্ধে। কনস্টেবল হিসেবে চাকরিতে যোগ দেওয়া লাভলী এসআই হিসেবে পদোন্নতি পাওয়ার পরও ইউনিট পাল্টিয়ে প্রায় এক যুগেরও বেশি সময় দ্বিতীয় স্বামীর বাড়ি কক্সবাজারে অবস্থান করছেন। এ কারণে তার অপকর্মের ডালপালা বিস্তার লাভ করেছে বলে স্থানীয়দের অভিযোগ।

ফাঁস হওয়া একটি অডিওতে শোনা যায়, বাদীপক্ষের জনৈক ব্যক্তি দশ হাজার টাকা দেয়ায় অসন্তোষ প্রকাশ করে এসআই লাভলী বলেন, আমি যা আশা করছিলাম তার চার ভাগের একভাগও হয়নি। না না না, দশ হাজার দিলে হবে না। আমরা দু’দিক হাতে রেখে কাজ করি। অন্য রিপোর্ট দেওয়াও কোনো বিষয় না।

অপরদিকে, এসআই লাভলী ফেরদৌসী ও তার স্বামীর কর্মকাণ্ডে সংসার ভেঙেছে এমন দাবি করে ঈদগাঁওয়ের ভুক্তভোগী রাজিয়া সুলতানা রিমি বলেন, আমার স্বামীসহ শ্বশুরবাড়ির কয়েকজনের বিরুদ্ধে আদালতে একটা লাঞ্ছনার মামলা করলে তা তদন্তে পিবিআইকে দেওয়া হয়। ওই মামলার আইও হন এসআই লাভলী ফেরদৌসী। কিন্তু দুঃখজনক হলো মামলার তদন্তে সঙ্গে আসা তার স্বামী পরিচয়ে শাহাজান নামের এক ব্যক্তি আমার পক্ষে রিপোর্ট দিতে ৫০ হাজার টাকা দাবি করেন। আমি তাকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে আমার অসহায়ত্বের কথা তুলে ধরি। তারা চলে গিয়ে আমার স্বামী ও শ্বশুরবাড়ি থেকে দাবি মতো ৫০ হাজার টাকা পেয়ে রিপোর্টটি আমার বিরুদ্ধে দেয়।

তিনি আরও বলেন, এসব তথ্য উল্লেখ করে আমি পিবিআইয়ের পুলিশ সুপারকে লিখিত অভিযোগ দিয়ে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তনের অনুরোধ করেও কোনো লাভ হয়নি। আর তার মিথ্যা প্রতিবেদনের কারণে আমার সংসার ভেঙে গেছে এবং আমার সঙ্গে ঘটে যাওয়া সত্য ঘটনাও চাপা পড়ে যায়।

এছাড়া কক্সবাজার শহরের পাহাড়তলী এলাকার ফরিদা নামে এক গৃহবধূ জানান, এসআই লাভলী ফেরদৌসী টুরিস্ট পুলিশে থাকা অবস্থায় একদিন আমাদের কাছে এসে বলেন, টুরিস্ট পুলিশ থেকে বদলি হতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে মোটা অংকের ঘুষ দিতে হচ্ছে। কিছু টাকা অপূর্ণ রয়েছে উল্লেখ করে, দীর্ঘদিনের পরিচয়ের সূত্রে লাভলী ফেরদৌসি ও তার স্বামী শাহজাহান আমাদের কাছে সহযোগিতা চান। আমি নিজের স্বর্ণ বন্ধক রেখে টাকা দিয়ে সহযোগিতা করেছি। কিন্তু বুঝতে পারিনি তারা স্বামী-স্ত্রী এতটা প্রতারক। বন্ধুত্বের সুযোগ নিয়ে আমাদের ক্ষতি করেছে। পারিবারিকভাবে চরমভাবে অশান্তিতে পড়েছি। এ ঘটনায় ন্যায় বিচার চেয়ে পিবিআইয়ের মহাপুলিশ পরিদর্শক, এআইজি ও পিবিআই এর এসপিকে লিখিত অভিযোগ দিয়েছি গত ১৮ আগস্ট।

এছাড়াও পুলিশী ক্ষমতার অপব্যবহার করে অন্যের বসতবাড়ি দখলের চেষ্টার অভিযোগ উঠেছে এসআই লাভলীর বিরুদ্ধে। স্থানীয় থানায় প্রভাব খাটিয়ে ও মিথ্যা তথ্য দিয়ে লাভলীর স্বামী শাহজাহানের নেতৃত্বে চাচার বসতবাড়ি দখল চেষ্টার অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা। ইতোমধ্যে কয়েকবার বাড়িতে হামলাও করেছে বলে অভিযোগ করেছেন তার (শাহজাহানের) চাচা রামুর চেইন্দা এলাকার ভুক্তভোগী ছৈয়দ আহমদ।

তিনি বলেন, আমার ছেলে সন্তান না থাকায় ভাতিজারা প্রায় সময় চাষের জমি দখলের চেষ্টা চালায়। তাদের থেকে আলাদা হয়ে আমার বসতবাড়ি সংস্কার করতে গেলে সেখানে বাধা দেয় শাহাজাহান ও তার সহোদররা। আমি আইনের আশ্রয় নিতে গেলে এসআই লাভলী থানায় (রামু থানায় একসময় কর্মরত ছিলেন) প্রভাব বিস্তার করেন। ফলে ন্যায়বিচার পাচ্ছি না। বর্তমানে আমার অবিবাহিত দু’মেয়ে নিয়ে চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। একজন পুলিশ কর্মকর্তার এ ধরনের আচরণ কোনোভাবে মেনে নেওয়া যায় না। তাই আমার ভোগান্তির কথা উল্লেখ করে গত ১১ আগস্ট পিবিআইয়ের উপ-মহাপুলিশ পরিদর্শক (ডিআইজি)সহ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লিখিত অভিযোগ দিয়েছি।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, লাভলী কক্সবাজার কোর্ট পুলিশে কর্মরত থাকা অবস্থায় রামুর চেইন্দা এলাকার বেলাল আহমদের ছেলে সুদর্শন শাহাজাহানের সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়েন। পরে তার স্বামী পুলিশ কর্মকর্তা এসআই সাইফুলকে সন্তানসহ ত্যাগ করে প্রেমিক শাহজাহানকে বিয়ে করেন লাভলী। পুলিশ কর্মকর্তাকে স্ত্রী হিসেবে পেয়ে বেপরোয়াভাবে অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন কর্মহীন শাহজাহান। তার বিরুদ্ধে প্রতারণা, ইয়াবা ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ, মামলা তদন্তে প্রভাব এমন কি পুলিশ কর্মকর্তা না হয়েও নিজেই স্ত্রীর মামলা তদন্ত করার অসংখ্য অভিযোগ উঠে এসেছে। বিষয়টি নিয়ে পিবিআই কক্সবাজার শাখায় কর্মরত কর্মকর্তাদের অনেকেই বিব্রত বলে জানান।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে পিবিআইয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, বিভিন্ন সময় মামলা তদন্তে যাওয়ার সময় স্বামীকে সঙ্গে নিয়ে যান এসআই লাভলী। যা আইনত তিনি করতে পারেন না। বিষয়টি আমাদের জন্য বিব্রতকর।

জানতে চাইলে এসআই লাভলী ফেরদৌসী সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, তদন্তের জন্য আমাকে তেমন মামলা দেওয়া হয় না। এরপরও আমার স্বামীর বাড়ি যেহেতু এখানে, বাদী বিবাদী হয়তো সুবিধা নিতে আমার স্বামীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে। কিন্তু, স্বামীর প্রভাব মুক্ত থেকেই কাজ করে আসছি। তবে, প্রচার পাওয়া অডিওর বিষয়ে কোনো সদুত্তর দেননি তিনি।

এ বিষয়ে পিবিআইয়ের কক্সবাজার পুলিশ সুপার (এসপি) সরওয়ার আলম বলেন, অভিযোগগুলো অবগত হয়েছি। গত ৬ মাসে লাভলীকে মাত্র একটা মামলা তদন্তের জন্য দেওয়া হয়েছে। অভিযোগ তদন্ত করে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তবে, বসতবাড়ি দখল চেষ্টার বিষয়টা তাদের পারিবারিক বলে জেনেছি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পিবিআই প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার বলেন, ওই নারী এসআইয়ের বিরুদ্ধে উঠা কিছু অভিযোগের বিষয়ে আমি অবগত আছি। তবে, সে কি এখনো কক্সবাজারে কর্মরত? এমন প্রশ্ন করে পিবিআই প্রধান বলেন, আজই খবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

Sharing is caring!

বিজ্ঞাপন

আর্কাইভ

সর্বশেষ খবর

………………………..