সিলেট ৪ঠা ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৯শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ১লা জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি
প্রকাশিত: ১১:২৮ অপরাহ্ণ, জুলাই ৩১, ২০২১
ক্রাইম সিলেট ডেস্ক : নিজের কৃতকর্মের কারণে পুরোপুরিই ফেঁসে যাচ্ছেন আওয়ামী লীগের উপকমিটির পদ হারানোর পর গ্রেপ্তার হওয়া ব্যবসায়ী হেলেনা জাহাঙ্গীর।
গ্রেফতারের পর দেশজুড়ে আলোচনায় থাকা হেলেনাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন (র্যাব)। জিজ্ঞাসাবাদকালে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে আইনশৃঙ্খল রক্ষাকারী এই বাহিনী।
র্যাব জানায়, দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে প্রথমে সখ্যতা গড়ে পরবর্তী সময়ে তাদের ব্ল্যাকমেইল করতেন হেলেনা। এরপর আদায় করতেন টাকা। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
শনিবার দুপুরে উত্তরা র্যাব সদরদপ্তরে হেলেনা জাহাঙ্গীর সম্পর্কে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক।
এসময় খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘হেলেনা সুনির্দিষ্ট একজন ব্যক্তির জন্য থেমে থাকেননি। প্রতিনিয়ত বিভিন্ন লোকজনের সঙ্গে পরিচয় ঘটেছে তার। উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য যাকেই প্রয়োজন হয়েছে তাকে তিনি ঘায়েল করেছেন। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে ছবি তুলেছেন এবং সেটা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়েছেন শুধু উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য। আমাদের মামলার কারণ এটাই। তিনি রাষ্ট্রের ব্যক্তিদের সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন, যা তাদের বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে, জনগণের মধ্যেও বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।’
হেলেনা জাহাঙ্গীর গত দুই বছরে বিভিন্ন মাধ্যম এবং টেলিভিশনে চাকরি দেওয়ার নামে টাকা আদায় করেছেন দাবি করে মঈন বলেন, ‘টেলিভিশনে চাকরি দেওয়ার নামে, এজেন্সি দেওয়ার কথা বলে সারা দেশের বিভিন্নজনের কাছ থেকে বিভিন্ন পরিমাণ টাকা আদায় করতেন। কারও কাছ থেকে দশ হাজার কাছ থেকে বিশ হাজার টাকা, আবার কারও কাছ থেকে এক লাখ টাকা নিয়েছেন বলে আমরা প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছি। কী কারণে টাকা নিয়েছেন এবং কী কাজে ব্যবহার করা হয়েছে- এ বিষয়ে হেলেনা জাহাঙ্গীর কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।’
র্যাব কর্মকর্তা বলেন, ‘এসবের দায় অফিস স্টাফদের ওপর চাপিয়েছেন তিনি। বাসায় এবং অফিস থেকে যে পরিমাণ ভাউচার পাওয়া গেছে তা এখন পর্যালোচনা করা হচ্ছে। জয়যাত্রা টেলিভিশনের আইডি কার্ড ব্যবহার করে অনেক প্রতিনিধিও এই চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে বলে আমরা জানতে পেরেছি।’
মঈন বলেন, ‘হেলেনা জাহাঙ্গীর আমাদেরকে জানিয়েছেন, তার ১৫ থেকে ১৬টি ফ্ল্যাট রয়েছে। এছাড়া বেশ কয়েকটি ফাউন্ডেশনের সঙ্গে তিনি জড়িত। বিভিন্ন সময় চাঁদাবাজি কিংবা ব্ল্যাকমেইল করে আদায় করা টাকাগুলো তিনি ফাউন্ডেশনে কাজে লাগাতেন। সুনামগঞ্জে তিনি ত্রাণ বিতরণ করায় স্থানীয়রা তাকে পল্লীমাতা উপাধি দিয়েছেন। ফাউন্ডেশনের নামে প্রবাসীদের কাছ থেকে অনেক টাকা এনেছেন। এগুলো কী কাজে ব্যবহার করা হয়েছে সে বিষয়ে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি।’
র্যাব কর্মকর্তা বলেন, ‘ফ্ল্যাট কিংবা গাড়ির সংখ্যা কতগুলো সে বিষয়ে প্রকৃত কোনো তথ্য আমাদের দিতে পারেননি হেলেনা। কখনও ছয়টি গাড়ি, কখনও আটটি গাড়ির কথা উল্লেখ করেন। এসব বিষয়ে যারা তদন্ত করবেন তারা খতিয়ে দেখবেন। তার আয়ের উৎস সম্পর্কে সিআইডি কিংবা দুর্নীতি দমন কমিশন কার্যকর ভূমিকা রাখবে।’
খন্দকার মঈন বলেন- জিজ্ঞাসাবাদে হেলেনা জাহাঙ্গীর র্যাবকে আরও জানান, সম্প্রতি তিনি রাজনীতিতে যোগ দেন। সামাজিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে নিজেকে সমাজসেবক হিসেবে তুলে ধরার প্রচেষ্টায় ছিলেন। বেশ কয়েকবার তিনি নির্বাচন করতে চেয়েছিলেন। তিনি শুধু নিজের অবস্থান উচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যই এ ধরনের অপপ্রয়াস ও অপতৎপরতা চালিয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন দেশের মানুষ তাকে চিনবে।
গত বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে আটটায় গুলশানে হেলেনা জাহাঙ্গীরের বাড়িতে অভিযান শুরু হয়। চার ঘণ্টার অভিযান শেষে তাকে আটক করে র্যাব সদরদপ্তরে নেওয়া হয়। উদ্ধার করা হয় বিদেশি মদ, ক্যাসিনো সরঞ্জাম, চাকু, ওয়াকিটকিসহ বিভিন্ন অবৈধ সরঞ্জাম। এরপর রাত দেড়টা থেকে চারটা পর্যন্ত রাজধানীর মিরপুর-১১ নম্বরের এ ব্লকের তিন নম্বর রোডে জয়যাত্রা টেলিভিশনের কার্যালয়ে অভিযান চালায় র্যাব। অভিযানে বিভিন্ন অবৈধ সরঞ্জাম জব্দ করা হয়।
এখন পর্যন্ত তার নামে তিনটি মামলা করা হয়েছে। হেলেনাকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তিন দিনের রিমান্ডে পেয়েছে পুলিশ।
এদিকে, দেশজুড়ে আলোচনায় থাকা হেলেনা জাহাঙ্গীর গ্রেফতারের আগে সিলেট এসে ঘুরে গেছেন কয়েকবার। তার গড়া ‘জয়যাত্রা ফাউন্ডেশন’ সিলেট বিভাগীয় কমিটির আয়োজনে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণ করেন তিনি। এসব অনুষ্ঠানে বক্তৃতাকালে আর্থিক অনুদানের অনেক প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করলেও পরবর্তীতে সেসব রক্ষা করেননি হেলেনা।
একনজরে হেলেনা জাহাঙ্গীর :
হেলেনা জাহাঙ্গীরের জন্ম ১৯৭৪ সালের ২৯ আগস্ট ঢাকার তেজগাঁওয়ে। উইকি ফ্যাক্টসাইডার নামের একটি ওয়েবসাইটে তার পেশা হিসেবে অ্যাংকর বা উপস্থাপক উল্লেখ করা হয়েছে। হেলেনার স্বামী জাহাঙ্গীর আলম একজন ব্যবসায়ী। ১৯৯০ সালে তারা বিয়ে করেন। তিনি তিন সন্তানের জননী।
হেলেনা জাহাঙ্গীরের বাবা মরহুম আবদুল হক শরীফ ছিলেন জাহাজের ক্যাপ্টেন। সেই সূত্রে জন্ম কুমিল্লায় হলেও হেলেনা জাহাঙ্গীরের বেড়ে ওঠা চট্টগ্রামের হালিশহরের মাদারবাড়ী, সদরঘাট এলাকায়। পড়াশোনা স্থানীয় কৃষ্ণচূড়া স্কুলে।
এফবিসিসিআই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে একাধিক গণমাধ্যমকে হেলেনা জাহাঙ্গীরের দেয়া সাক্ষাৎকার সূত্রে জানা যায়, বিয়ের সময় স্বামী জাহাঙ্গীর আলম নারায়ণগঞ্জের একটি প্রতিষ্ঠিত পোশাক কারখানার জিএম পদে চাকরি করতেন। পাশাপাশি সিএন্ডএফ এজেন্ট ব্যবসার সঙ্গেও সংশ্লিষ্টতা ছিল।
তবে গৃহিণী হিসেবে বসে না থেকে পড়াশোনা শেষ করে হেলেনা জাহাঙ্গীর শুরুতে চাকরির চেষ্টা করেন। বিভিন্ন জায়গায় চাকরির জন্য ইন্টারভিউও দিয়েছেন তিনি। একদিন চাকরি খোঁজার সূত্র ধরে চলে যান স্বামী জাহাঙ্গীর আলমের অফিসে। সেখানে স্বামীর অফিস কক্ষ দেখে তিনি ঠিক করেন নিজেই উদ্যোক্তা হওয়ার। স্ত্রীর প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান স্বামী জাহাঙ্গীর আলম।
বিয়ের ছয় বছর পর ১৯৯৬ সালে রাজধানীর মিরপুর ১১ তে একটি ভবনের দুটি ফ্লোর নিয়ে তিনি শুরু করেন প্রিন্টিং ও অ্যামব্রয়ডারি ব্যবসা।
সম্প্রতি চাকরিজীবী লীগ নামে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে নেতা বানানোর আহ্বান জানানোর একটি পোস্টকে কেন্দ্র করে বিতর্ক জন্ম দেন হেলেনা জাহাঙ্গীর। কথিত এই সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতি হিসেবে হেলেনা জাহাঙ্গীর ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে মাহবুব মনিরের নাম উল্লেখ করা হয়।পরে আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক উপ-কমিটি থেকে তার সদস্য পদ বাতিল করা হয়।
গত রবিবার হেলেনা জাহাঙ্গীরকে অব্যাহতি দিয়ে আনুষ্ঠানিক সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। বিজ্ঞপ্তিতে উপকমিটির সদস্যসচিব ও আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক মেহের আফরোজ সই করেন। এতে বলা হয়, হেলেনা জাহাঙ্গীর আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক উপকমিটির সদস্য ছিলেন। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত তার সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড সংগঠনের নীতিবহির্ভূত হওয়ায় আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক উপকমিটির সদস্যপদ হতে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। অবশেষে বৃহস্পতিবার (২৯ জুলাই) দিবাগত রাত সোয়া ১২টায় রাজধানীর গুলশানের তার বাসা থেকে তাকে আটক করে র্যাব। সূত্র- সিলেট ভিউ
Sharing is caring!
………………………..
Design and developed by best-bd