সিলেটবাসীর জন্য ‘মরার উপর খাড়ার ঘা’

প্রকাশিত: ১১:৫১ অপরাহ্ণ, জুন ৭, ২০২১

সিলেটবাসীর জন্য ‘মরার উপর খাড়ার ঘা’

নিজস্ব প্রতিবেদক :: করোনা লকডাউন শেষ হতে না হতেই সিলেটবাসীর মাথার উপর দাঁড়িয়েছে ভূম্পিকম্প আতঙ্ক। ভূম্পিকম্পে সিলেটের ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেট গুলো বন্ধ থাকায় অনাহারে অর্ধাহারে মানবেতর দিনযাপন করছে হাজার হাজার ব্যাবসায়ী পরিবার। একদিকে করোনা-অপরদিকে ভূম্পিকম্পে মার্কেট বন্ধ থাকায় সিলেটবাসীর জন্য ‘মরার উপর খাড়ার ঘা’ হয়ে পড়েছে। বন্ধ হয়ে যাচ্ছে মানুষের জীবন চালিকা শক্তি। বেজে ওঠতে শুরু করেছে মহাদুর্ভোগ ও দুর্ভিক্ষের ঘনঘন্ট। দেশের স্বর্ণের খনি বলে খ্যাত পাথর-বালুময় সিলেটের গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ ও কানাইঘাট কোয়ারী গুলো বন্ধ থাকায় লাখ লাখ বণি আদমের এখন যাওয়ার কোন জায়গা নেই। সূযোগ নেই বন্দুকের নলের মূখে সীমান্ত পেরিয়ে ভারত চলে যাওয়ার।

এক সপ্তাহের ব্যবধানে আবারও ভূম্পিকম্পে কেঁপে উঠেছে সিলেট। সোমবার সন্ধ্যা ৬টা ২৯ মিনিটে ও ৬টা ৩০ মিনিটের দিকে দুই দফা ভূমিকম্পে আতঙ্কে ছড়িয়ে পড়ে। সবগুলো ভূমিকম্পের উৎস ছিল সিলেট অঞ্চলেই। বাংলাদেশের একটি অঞ্চল থেকে ভূমিকম্প উৎপত্তি হবার নজিরবিহীন ঘটনা বিশেষজ্ঞদেরও ভাবিয়ে তুলেছে। তারা বলছেন, বড় ভূমিকম্পের আগে বা পরে এমন দফায় দফায় মৃদু কম্পন হতে পারে।

এর আগে সর্বশেষ গত ৩০ মে মৃদু ভূমিকম্প অনুভূত হয়। ওইদিন ভোর ৪টা ৩৫ মিনিট ৭ সেকেন্ডে দুই দশমিক ৮ মাত্রার ভূ-কম্পন অনুভূত হয়। তার আগের দিন অর্থাৎ ২৯ মে দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের একদিনে চার দফা ভূ-কম্পন অনুভূত হয় সিলেটে। এর উৎপত্তিস্থল সিলেটের জৈন্তাপুর ও এর আশপাশে ছিল। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে একই এলাকায় ভূমিকম্প অনুভূত হয়। ২০২০ সালের এপ্রিলে সিলেট অঞ্চলে আরেকটি ভূমিকম্প হয়। এগুলো ছোটমাত্রার ভূমিকম্প ছিল।

ঢাকা আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের সিনিয়ার আবহাওয়াবিদ মুমিনুল ইসলাম বলেন, সিলেট অঞ্চল দীর্ঘদিন ধরেই ভূমিকম্পের ঝুঁকির মধ্যে। বিশেষ করে তিনটি পেল্গটের সংযোগস্থলে বাংলাদেশ। ভারতের মেঘালয়ের শিলং থেকে সিলেট হয়ে ভুটান পর্যন্ত ভূগর্ভে যে চ্যুতি আছে, তাতে বিপুল পরিমাণে শক্তি জমা হয়েছে। সিলেট থেকে ৫০-৬০ কিলোমিটার দুরে এ চ্যুতি। ফল্টলাইনগুলোকে ভূকম্পন হয়। ভূমিকম্পের প্রিশক ও আফটারশক থাকে। অনেক সময় বড় ভূমিকম্পের আগে ছোট কম্পন হয়। আবার বড় ভূমিকম্প হলে তারপর ছোট ছোট কম্পন হয়। যেহেতু সিলেট অঞ্চল ভূমিকম্প প্রবণ সেজন্য সতর্ক থাকতে হবে।

ভূমিকম্পের প্রবণতা নিয়ে ২০০৩ সাল থেকে গবেষণা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক হুমায়ুন আখতার। তার গবেষণা মডেল বলছে ইন্ডিয়ান, ইউরেশিয়ান এবং বার্মা তিনটি গতিশীল পেল্গটের সংযোগস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান।

তিনি জানান, দেশে বিপজ্জনক ভূকম্পনের প্রধান দুটি উৎস হচ্ছে- ৩০০ কিলোমিটার দীর্ঘ ডাউকি ‘ফল্ট’ এবং টেকনাফ-পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি অঞ্চল সাবডাকশন জোন। আর্থ অবজারভেটরি ভূকম্পনগুলোর উৎপত্তিস্থল হিসেবে শনাক্ত করেছে সিলেটের জৈন্তাপুর এলাকার লালাখাল সংলগ্ন এলাকাকে, যেটা বিপজ্জনক ডাউকি ‘ফল্টের’ পূর্ব প্রান্তের কাছাকাছি।

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক প্রফেসর ড. জহির বিন আলম বলেন, স্থানীয়ভাবে উৎপত্তি হওয়া এই ভূমিকম্প নিয়ে এখনো উপসংহারে পৌঁছানো যাচ্ছে না। ধারণা আছে, মেঘালয়ে পাথরের পাহাড় ধ্বংস করতে বিস্ফোরক ব্যবহার করা হয়। এর ফলে এটি হচ্ছে কিনা- তা খতিয়ে দেখতে হবে। অথবা অন্যকোনো কারণে হতে পারে।

সিলেটের পাশেই ভূমিকম্পের ডাউকী ফল্ট। এটি ভূমিকম্পের ডেঞ্জার জোন। গত ২৯ মে জৈন্তাপুরে যে ভূমিকম্প হয়েছে সেটি ডাউকী ফল্টের একেবারে নিকটবর্তী এলাকা। ডাউকী ফল্টের বিস্তৃত মেঘালয়, আসাম, নেপাল, সিলেট। ফলে ছোটো ছোটো ভূমিকম্পের কারণে ঝুঁকিতে থাকা ডাউকী ফল্ট নিয়ে চিন্তা বাড়ছে বলে জানিয়েছেন ভূ-তাত্ত্বিক বিশেষজ্ঞরা।

বিশেষজ্ঞরা জানান, পৃথিবীর উপরিভাগের ৭০-১০০ কিলোমিটার পুরুত্বের লিথোস্টিম্ফয়ার ছোট-বড় ১৩টি খণ্ডে (প্লেটে) বিভক্ত। উত্তপ্ত ও নরম এস্থোনোস্ফিয়ারের ওপর ভাসমান এ প্লেটগুলো গতিশীল। প্লেটগুলো গতিশীল থাকায় ভূখণ্ড ধীরে ধীরে সরতে থাকে, যেটাকে ‘অ্যাকটিভ ফল্ট’ বা সক্রিয় চ্যুতি বলা হয়। প্লেটের স্থানচ্যুতির সময় জমে থাকা শক্তি বিপুল বেগে বের হয়, তখন সংযোগস্থলে ভূম্পন হয়। বাংলাদেশের উত্তরে ইন্ডিয়ান প্লেট ও ইউরেশিয়ান প্লেটের সংযোগস্থল; পূর্বে বার্মিজ প্লেট ও ইন্ডিয়ান প্লেটের সংযোগস্থল। উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সিলেটের ডাউকি অঞ্চলে রয়েছে এমন ফল্ট।

আর ‘সাবডাকশন জোন’ সমুদ্র তলদেশের এমন এলাকা যেখানে দুটি টেকটনিক প্লেট মুখোমুখি অবস্থানে থাকে এবং প্লেট দুটো পরস্পরের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। এমন অবস্থায় একটি টেকটনিক প্লেট আরেকটি নিচে চলে গেলে সৃষ্টি হয় ভূমিকম্প। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের উপকূল বরাবর বঙ্গোপসাগরের এক বিশাল ‘সাবডাকশন জোন’ রয়েছে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, ভূমিকম্পের জন্য বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চল আগে থেকেই ঝুঁকিতে আছে। এই অঞ্চলে অতীতে তিনবার বড় ধরনের ভূমিকম্প হওয়ার ইতিহাস আছে। ফলে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।

Sharing is caring!

বিজ্ঞাপন

আর্কাইভ

সর্বশেষ খবর

………………………..