মসজিদের মাইকের ব্যবহার ও অপব্যবহার

প্রকাশিত: ৯:০০ অপরাহ্ণ, মার্চ ২৭, ২০২০

মসজিদের মাইকের ব্যবহার ও অপব্যবহার

সাইফুল আলম: মসজিদ আমাদের বিশেষ করে মুসলমানদের সর্বোচ্ছ পবিত্র স্থান।এখানে যা কিছু করা হয় স্বয়ং আল্লাহ তাআলা কে সন্তুষ্টি করার জন্য। নামায,খুৎবা,ধর্মীয় আলোচনাই মূলত সেখানে নিয়মিত হয়।প্রত্যেক মসজিদে মাইক (শব্দ যন্ত্র) রয়েছে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের আগে আযান, শুক্রবারে জুম্মার আগে কিছুক্ষন ধর্মীয় আলোচনা হয়ে থাকে। এছাড়াও এলাকার কেউ মারা গেলে মৃত্যু সংবাদ প্রচার ,ক্ষেত্রবিশেষে অন্যান্য জরুরী কিছু ঘোষনা দিয়ে থাকে।আমার ছোটবেলায় গ্রামের মসজিদে প্রয়াত ধনা মুন্সি চাচা আযান দিত,ফযরের আযানের আগে জিকির করত। তার কন্ঠে কি যে মধুর আযান কিংবা জিকির ছিল বলে বুঝানোর ভাষা নেই।২৫ বছর আগের সেই কন্ঠে “ও মন ঘুমাইও নারে নাম জপ আল্লাহর, একদিনও ঘুমাইয়া যাইবা কয়বের মাজারও, ও মন ঘুমাইও নারে” ফযরের আযানের আগে গাওয়া গজল আজও কানে শুনতে পাই।প্রতিদিন ফযরের আযানের আগে মিনিট পাচেক এরকম গজল পরিবেশন করতেন ধনা চাচা।আর এই গজল এবং পরে ফযরের আযানের সুরে আমাদের ঘুম ভেঙ্গে যেত। আম্মা তখন আমাদের কে ডেকে দিত মক্তবে যাওয়ার জন্য।তখন দেখতাম কৃষিকাজে যুক্ত গ্রামের চাচা,ভাইয়েরা মাঠে যাওয়ার প্রস্তুতি নিত। ধনা ভাইয়ের আযানের সুরে মুগ্ধ হয়ে আমি এক সময় ভাবতে লাগলাম নিজেও মসজিদের মাইকে আযান দিব।সেই অনুযায়ী আমার বয়স যখন ১৪/১৫ বছর তখন আমি আমার গ্রামের সবচেয়ে বড় জামে মসজিদে মাঝে মাঝে সুযোগ পেলে আযান দিতাম।অনেকেই আমার আযান সুন্দর হত বলে প্রশংসা করত।যদিও এটা পরবর্তীতে বেশি দিন আমলে রাখতে পারিনি।তবে এখনো আত্ববিশ্বাস আছে আমি আযান দিলে অনেকের চেয়েই সুন্দর হবে।এতো গেল মসজিদের মাইকে আমার জীবনে কিছু শিক্ষনীয় বিষয়।ধর্মীয় আমল কিংবা ক্ষেত্র বিশেষে সামাজিক শৃংখলার জন্য মসজিদের মাইক খুবই গুরুত্বপূর্ণ ।এর সঠিক চর্চায় সমাজ থেকে হিংসা,বিভেদ,কলহ দুর হতে পারে।তবে ইদানিং মসজিদের মাইকের কিছু অপব্যবহারও দেখতে পাই।

এইবার পেশাগত কিছু অভিজ্ঞতার কথা শেয়ার করি। একবার কোন এক জায়গায় চিহ্নিত ডাকাত ধরতে অভিযান বের হইছি।আমাদের সিস্টেম অনুযায়ী ডাকাতের বাড়ি ফোর্স অফিসার দিয়ে কর্ডন করে আমি দরজায় নিজের পরিচয় দিয়ে নক করলাম দরজা খুলতে।ভিতরে ফিস ফিস কি যেন শুনতে পেলাম।মিনিট বাদে পার্শ্ববর্তী মসজিদের মাইকে (যে ডাকাত কে ধরতে গেলাম তার নাম ধরে) শুনতে পেলাম অমুকের বাড়িতে ডাকাত ডুকছে যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে যেন প্রতিহত করতে যায়।এই ঘোষনার দুই তিন মিনিটের মধ্যেই কয়েকশত লোক লাটি,রামদা,ফিকল নিয়ে আমাদের দিকে তেরে আসতে শুরু করল। দলনেতা হিসেবে নিজের বিচক্ষন বুদ্ধিমত্তায় পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছিলাম।রাতের বেলা আসামী ধরতে গিয়ে প্রতিনিয়ত এরকম পরিস্থিতির মুখামুখি হতে হয়। অনেকে বলবেন মাঝে মাঝে সত্যিকারে ডাকাত হানা দেয়,আমি অস্বীকার করছি না। সেক্ষেত্রে মাইকে ঘোষনা দেওয়ার আগে সংশিষ্ট থানার ডিউটি অফিসারের সাথে ১ মিনিট কথা বলে নিশ্চিত হওয়া যেতে পারে।আবার অনেক সময় এলাকায় মারামারির সংবাদ শুনে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রন করতে গিয়ে দেখা যায় দুই দিক থেকে মসজিদের মাইকে রীতিমত কোচের ভূমিকায় মারামারিতে ঝাপিয়ে পরার জন্য নির্দেশনা দিতে। মসজিদের মাইকের এরকম ব্যবহার কখনো আশা করা যায় না। এমনকি এটি কোনভাবেই ইসলামও সমর্থন করে না।

সম্প্রতি করোনা ভাইরাসের সংক্রমন ঠেকাতে সারা বিশ্ব হিমশিম খাচ্ছে। জনসমাগম ঠেকাতে পবিত্র মক্কা নগরীর হেরাম শরীফ এবং মদিনা শরীফে নামায সহ অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা কিছু ক্ষেত্রে সীমিত আবার কিছু ক্ষেত্রে বন্ধ রাখা হয়েছে।এরকম বাস্তবতায় বাংলাদেশের প্রখ্যাত আলেমদের পরামর্শ্যে আমাদের দেশেও জুম্মার নামায সহ অন্যান্য নামাযে বড় জামাতে আপাতত অংশগ্রহন করতে নিরুৎসাহি করা হয়েছে। এই যখন সামগ্রিক অবস্থা তখন গতকাল রাত ১২ টার দিকে হবিগঞ্জ সহ অনেক জায়গায় মসজিদের মাইকে রাত ২ টায় পৃথীবী ধ্বংস হয়ে যাবে/ভূমিকম্প হবে বলে ঘোষনা দিয়ে সবাইকে মসজিদে যাওয়ার অনুরোধ করা হয়।এই ঘোষনার পর হাজার হাজার মানুষ মিছিল করতে করতে যার যার মসজিদে যায়।সেখানে দোয়া করে ইমাম সাহেবের নেতৃত্বে আবার হাজার লোকের মিছিল হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের যখন এই অবস্থা তখন সনাতন ধর্মের ভাইদের কি আর ঘুমিয়ে থাকার সুযোগ আছে? তারাও তখন সবাই একসাথে বসে কীর্তন গাওয়া শুরু করে দেয়।কারন পৃথীবী ধ্বংস হলেতো তাদের পরিনামও একই হবে! এই হল করোনা ভাইরাস সংক্রমনে সামাজিক দুরত্বে থাকার নমুনা! মসজিদের মাইক থেকে যদি কেউ গুজব ছড়ায় তাহলে আমাদের আর যাওয়ার জায়গা কোথায়! কারন মসজিদ যে সবার আস্থার জায়গা। মসজিদের মাইকে এরকম বিভ্রান্ত না ছড়িয়ে প্রতি ওয়াক্ত আযানের আগে কিংবা পরে করোনা ভাইরাসের সংক্রমন প্রতিরোধে স্বাস্হ্য বিধি অনুযায়ী প্রনিত নির্দেশিকা প্রচার সহ সবাইকে ঘরে থাকার অনুরোধ করে ঘোষনা দিলে সমাজের অনেক উপকার হতে পারে।

হে প্রভু আমাদের কে জ্ঞান দাও। তোমার সৃষ্ট করোনা ভাইরাস নামক মহামারি থেকে আমাদের রক্ষা কর।পাশাপাশি কিছু মুর্খ কর্তৃক সৃষ্ট গুজব নামক মহামারি থেকেও আমাদের কে রক্ষা কর।তাদের কে হেদায়ত কর।

লেখক- সাইফুল আলম,অফিসার ইনচার্জ, জেলা গোয়েন্দা শাখা (উত্তর), সিলেট।

Sharing is caring!

বিজ্ঞাপন

আর্কাইভ

সর্বশেষ খবর

………………………..