পুলিশের যত ক্ষোভ-অসন্তোষ

প্রকাশিত: ১০:০৪ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ৭, ২০২০

পুলিশের যত ক্ষোভ-অসন্তোষ

ক্রাইম সিলেট ডেস্ক : সাংগঠনিক কাঠামো ও অপারেশনাল কার্যক্রম শক্তিশালী করতে কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে পুলিশের পদোন্নতি না হওয়া, মামলাজট বৃদ্ধি, পর্যাপ্ত যানবাহন না থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। পাশাপাশি জেলার আইনশৃঙ্খলা রিভিউ কমিটির কার্যক্রম ও মাদক-সংক্রান্ত কমিটিতে পুলিশের উপযুক্ত অবস্থান না থাকায় অসন্তোষ প্রকাশ পেয়েছে।

মঙ্গলবার (৭ জানুয়ারি) বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব মোস্তফা কামালের সঙ্গে বৈঠকে এসব ব্যাপারে ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করেন পুলিশ কর্মকর্তারা। সভায় ১০ এসপিসহ ঊর্ধ্বতন ১৯ পুলিশ কর্মকর্তা কথা বলেন এবং সমস্যা নিরসনে কার্যকরী পদক্ষেপের দাবি জানান। এর আগে নির্দেশ সত্ত্বেও পুলিশের দাবি পূরণ না হওয়ায় প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ওপর অসন্তোষ প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী।

সভায় র‌্যাব ডিজি বেনজীর আহমেদ বলেন, ‘মানুষ কোর্টের বারান্দায় বারান্দায় ঘোরে, বছরের পর বছর মামলা ঝুলে থাকে। পুলিশের পক্ষে যথা সময়ে মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হলেও মামলা ঝুলে থাকায় জনমনে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে, যা কিনা পুলিশের ওপরই বর্তায়। ১৪ লাখ ঝুলে থাকা মামলার সংখ্যা এখন দাঁড়িয়েছে ৩৫ লাখে। এসব মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি দরকার। এজন্য আইন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় জরুরি।’

তিনি আরও বলেন, ‘মামলার দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য দরকার প্রসিকিউশন ও জুডিশিয়ারি। এ দুটির কোনোটাই স্বরাষ্ট্রে নেই। তাহলে মামলাজট কমাতে রিভিউ কমিটির কাজটা কি? একজন ম্যাজিস্ট্রেট প্রতিদিন ৩০০ মামলার শুনানি দেন। কিন্তু একজন জজের পক্ষে তা হচ্ছে? আর আইনজীবী তো নতুন ডেট দিলেই পয়সা।’

‘আইন বলছে প্রথম সাক্ষী হাজির করলে টাকা পাবে। কিন্তু ফাঁকফোকরে সেটা সাক্ষী পাচ্ছে না। কিন্তু সাক্ষী হাজির করতে হয় পুলিশকে। আবার সাক্ষী নিরুৎসাহিত হলে দোষ যায় পুলিশের ওপর।’

‘মামলার আলামত ও জব্দ তালিকা কোথায় রাখবো? নিম্ন আদালতে তো পিপি কিংবা কোর্ট সাব-ইন্সপেক্টরের কোনো কার্যালয় নেই। তাহলে এসব কোথায় রাখবে। অথচ এসবের ওপর অনেকের জীবন-মরণ নির্ভর করে। কিছু মিসিং হলে দায় কী তবে পুলিশের? এসবের সমাধান জরুরি।’

‘একেকটা মামলা নিষ্পত্তি হতে সময় লাগে ১২-১৫ বছর। নিয়ম অনুযায়ী, মামলার আলামত আদালত তার মালখানায় মজুত রাখবে। কিন্তু কয়টা কোর্টের মালখানা আছে?’

র‌্যাব ডিজি ক্ষোভ জানিয়ে বলেন, ‘পুলিশ হচ্ছে বাংলাদেশে ন্যাশনাল শক অ্যাবজরভার। যত দোষ পুলিশের ওপর চাপানো হয়। কিন্তু কাজের কাজ কারা করছে? গোড়ায় হাত না দিয়ে কমিটির পর কমিটি বানিয়ে কোনো লাভ হবে না।’

‘মাদকের মামলা, আইসিটি, নারী নির্যাতনের মামলার মেয়াদ নির্ধারিত। তাহলে আমাদের ওপর তো মামলা প্রলম্বিত হচ্ছে না। রায়ে কেন তবে দেরি হয়। মুলতবি মামলার অন্য গুরুত্ব আছে।’

ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম বাড়ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে পুলিশের কাজ করার কোনো ক্ষমতা নেই। জনগণ মনে করে পুলিশ চাইলেই পারে। কিন্তু আইনের কারণে পুলিশ যে পারে না সেটা তো জনগণ বোঝে না। হয় আমাদের দেন নয় তো তাদেরই দেন তবুও এ বিষয়টা নিষ্পত্তি হোক।’

র‌্যাব মহাপরিচালক বলেন, ‘পুলিশ হচ্ছে বেস্ট ল’ অ্যান্ড এজেন্সি ইন কান্ট্রি। যা বলবেন তাই করবে। কিন্তু পুলিশের ফোর্সে গাড়ি কম। অ্যাডিশনাল এসপি হচ্ছে অপারেশনাল ফোর্স। অথচ তার কোনো গাড়ি নেই। তাহলে সে ডিউটি কীভাবে করবে? সে কি তবে বাবার জমি বিক্রি করে ডিউটি করবে? ওকে তো দায়িত্বই দেয়া হয়েছে ডিউটি করবে।’ কিন্তু গাড়ি ছাড়া ডিউটি কীভাবে? একই পদমর্যাদার ও কম পদমর্যাদার অন্যরা যদি গাড়ি পায় তবে পুলিশে কেন নয়।’

আমাদের বাজেট হচ্ছে চার লাখ কোটি টাকা। র‌্যাব ২০০৪ সালে যে গাড়ি ব্যবহার করছে সেই গাড়ি এখনো চলছে। অথচ এখন ২০২০। যতো দেবেন ততো কাজের ইফিসিয়েনসি বাড়বে। দেশের স্বার্থে যখন যা বলবেন পুলিশ তা করবে। আশা করছি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ বিষয়গুলো দেখবে।’

আইজিপি মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী বলেন, পদোন্নতির ক্ষেত্রে যত দিন যাচ্ছে তত পিছিয়ে যাচ্ছে। আগে ২৪ বছরে অ্যাডিশনাল আইজিপি হতে পারতো কিন্তু এখন ৩০ বছরেও পারে না। আমাদের সামনে এখন কী অবস্থাটা দাঁড়াচ্ছে। ছয়শ এসপি হয়ে গেছে। এর মধ্যে অ্যাডিশনাল ডিআইজি হবে মাত্র ১০৭ জন। বাকিরা কেউ হতে পারবেন না। তারপর ডিআইজি ৬৭ জন। অর্ধেকও ডিআইজি হতে পারবেন না। অ্যাডিশনাল ডিআইজি ১৭ জন। তাহলে অবস্থানটা এমন দাঁড়িয়েছে যে, যদি এ থেকে উত্তোরণ ঘটানো না যায় তাহলে যে ব্যাচগুলো আসছে তারা তো এসপিই হতে পারবেন না। একটা কমিটি গঠন করে সমস্যা উত্তোরণের ব্যবস্থা করতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

র‌্যাব ডিজি বক্তব্যের জেরে আইজিপি বলেন, ৩৫ লাখ মামলা কেন জমে আছে? আইন মন্ত্রণালয়কে যদি দায়িত্ব দেয়া যায় তাহলে ঠিক মতো সমাধান করতে পারবে। কিন্তু যে রিভিউ কমিটি গঠন করা হয়েছে এসপি এবং ডিসির তো ৩৫ লাখ মামলা কমানোর কোনো সুযোগ নেই।

অপারেশনাল গাড়ির বিষয়ে তিনি বলেন, আগে চারজন ফোর্স নিয়ে অ্যাডিশনাল এসপি মুভ করতে পারতেন। এখন যে গাড়ি দেয়া হচ্ছে তা অপারেশনাল গাড়ি নয়। এখানে একজনের বেশি বসার অবস্থা থাকে না। আগের মতো অপারেশনাল গাড়ি সরবরাহের অনুরোধ জানান আইজিপি। মাদক-সংক্রান্ত কমিটিতে আইজিপি নেই, বিভাগীয় পর্যায়ে ডিআইজি তিন নম্বরে। জেলা পর্যায়েও একই অবস্থা। এ বিষয়েও সমাধান দাবি করা হয়।

সিআইডির ডিআইজি শাহ আলম ফৌজদারি মামলায় যথাযথ সমন্বয়ের জন্য পুলিশের হাতে প্রসিকিউশন ফিরিয়ে আনার দাবি জানান এবং মেট্রোপলিটন থানাসমূহে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অফিসার ইনচার্জ হিসেবে নিয়োগের অনুরোধ করেন।

আরও দাবি ওঠে, প্রত্যেক জেলায় মাদকসেবীদের জন্য বেসরকারি নিরাময় কেন্দ্রের পাশাপাশি সরকারি নিরাময় কেন্দ্র স্থাপন, সব স্টেকহোল্ডারকে নিয়ে জঙ্গিদের ডিরেডিকালাইজেশনের জন্য একটি কারেকশন সেন্টার স্থাপনের দাবি উত্থাপন করা হয়।

সিনিয়র স্বরাষ্ট্র সচিব মোস্তফা কামাল বলেন, পুলিশের ভূমিকা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। পুলিশের সুবিধা বাড়ানো মানে গণতন্ত্রের সুবিধা। মানুষ বিপদে পড়লে প্রথমে পুলিশের কাছে যায়। আমরা রাজনৈতিক সরকারের অধীনে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে কাজ করি। সংসদ সদস্যদের জবাবদিহিতা সংসদে কিন্তু আমাদের জবাবদিহিতা জনগণের কাছে।

তিনি বলেন, মামলা নিচ্ছেন না থানার ওসি। এজন্য এসপিসহ মামলার আসামি হয়ে ৩-৪ জন বিপদে আছেন। যদিও কোনো এসপি এমন নির্দেশনা দেন না। নির্ভয়ে পুলিশিং করতে হলে এসবের ব্যাপারে কথা বলতে হবে।

‘বিচার বিভাগ, দুদক, তথ্য কমিশন, নির্বাচন কমিশন স্বাধীন। আসলে সবাই স্বাধীন হলে রাষ্ট্র পরাধীন হয়ে যায়। সবার স্বাধীনতা ঠিক নয়। সেমিনার করে এ ব্যাপারে কথা বলতে হবে। সব দোষ কেন পুলিশের হবে। প্রত্যেকটা আইন করার সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাত-পা বেঁধে দেয়া হচ্ছে। কাস্টমস একটা আইন করেছে। সেটার বিরুদ্ধে আমি কথা বললেও সেটা বলতে পারেন অর্ধেক পাস হয়ে গেছে। কোনো একটা অবৈধ জিনিস কারো হাতে থাকলে যেটার কাস্টমস ডিউটি দেয়া হয়নি সেটা তালাশ করতে করতে মৃত্যু ঘটাতে পারবে। এটা কোন আইনে আছে? কোনো বিমানে যদি অবৈধ পণ্য থাকে তাহলে সেটা গুলি করে নামাতে পারবেন, এমন আইন। অথচ পুলিশ যখন আসামিকে ইন্টারগেট করা অবস্থায় মারা যায় তখন পুলিশ দোষী হয়। এসব আসলে দেখা দরকার।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, দিন শেষে সবার নজর থাকে পুলিশ কী করেছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কী করলো। বঙ্গবন্ধু পুলিশকে জনগণের পুলিশ হতে আহ্বান জানিয়েছিলেন। আমরা ধীরে ধীরে সেদিকেই যাচ্ছি। সেবার মান যাতে বৃদ্ধি পায় সেভাবে পুলিশকে গড়ে তোলা হচ্ছে। আপনাদের দাবি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলাপ করেছি। তিনি রিভিউ কমিটি যুগোপযোগী করার নির্দেশনা দিয়েছেন। নতুন কিছু যোগ করা যায় কিনা দেখা হবে।

‘মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণের যে কমিটি সেটা নিয়ে অধিদফতরকে বলবো পুলিশের আইজি, ডিআইজি এসপিসহ বর্ডার গার্ডের চিফকেও কমিটিতে যেন নিয়ে আসা হয়। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণে যদি অধিদফতর একাই কাজ করত তাহলে তো সুরক্ষা বিভাগের দরকার ছিল না। কাজ তো পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি করছে।’

‘আর্মির মেডিকেল কোরের মতো পুলিশের জন্যও মেডিকেল কোর করার নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। আমাদের মধ্যে চিকিৎসকের খুব অভাব রয়েছে। গাড়ি সমস্যা নিরসনে নতুন অপারেশনাল কাজে উপযোগী ও গাড়ির মডেল রিকুইজিশন পাঠাতে আহ্বান জানান তিনি।

Sharing is caring!

বিজ্ঞাপন

আর্কাইভ

সর্বশেষ খবর

………………………..