‘সিলেটের পত্রিকা বিক্রেতা জি কে শামীম এখন টাকার কুমির

প্রকাশিত: ৫:০৯ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ১৯, ২০১৯

‘সিলেটের পত্রিকা বিক্রেতা জি কে শামীম এখন টাকার কুমির

ক্রাইম সিলেট ডেস্ক : নব্বই দশকের শুরুতে মাত্র ৭০ টাকা নিয়ে বাড়ি ছাড়েন। সিলেটে এসে পত্রিকা বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছিলেন। কিছুদিন ফেরি করে কমলাও বিক্রি করেন। জকিগঞ্জের খলাদাপনিয়া গ্রামের আবদুল মোমিন চৌধুরীর ছেলে সেই জামাল আহমদ চৌধুরী এখন টাকার কুমির।

স্থানীয় লোকজন তাকে ‘সিলেটের জি কে শামীম’ নামেই বেশি চেনেন। জামাল আহমদ চৌধুরীর অর্ধশতাধিক ব্যাংক হিসাবে আছে কোটি কোটি টাকা। ঢাকা ও সিলেটসহ বিভিন্ন জায়গায় নামে-বেমানে একাধিক বিলাসবহুল বাড়ি, ফ্ল্যাট, গাড়ি ছাড়াও বহু জমি রয়েছে।

বিএনপির আমলে হারিছ চৌধুরীর আশীর্বাদে তিনি ফুলেফেঁপে উঠতে শুরু করেন। সিলেট বিভাগজুড়েই বিভিন্ন অফিসে ছিল তার দাপট। নানা কৌশলে বড় বড় টেন্ডার বাগিয়ে নেয়াই ছিল তার মূল কাজ।

ফলে সেনাসমর্থিত ১/১১-এর সরকারের সময় তার বিরুদ্ধে ১৬টি দুর্নীতি মামলা করা হলেও আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেন তিনি।

নিজের নাম ছাড়াও স্ত্রী, স্ত্রীর বড় ভাই, আমেরিকা প্রবাসী শ্যালক, অপর এক শ্যালকসহ নানা নামে বিভিন্ন কনস্ট্রাকশন ফার্ম খুলে কাজ বাগিয়ে নিতে থাকেন।

২০১৫ সাল থেকে তিনি প্রকল্প বাগিয়ে নিয়ে আইনবহির্ভূতভাবে দ্বিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে অন্যের কাছে কাজ বিক্রি করে দিতে শুরু করেন। সিলেটের ৪ জেলার গণপূর্ত বিভাগ, এলজিইডি ও শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরের এরকম ১২০ কোটি টাকার ৬৪টি প্রকল্প এখন তার কব্জায়।

সর্বশেষ শুদ্ধি অভিযান শুরু হলেও তিনি গা ঢাকা দেন। এরই মধ্যে যেসব প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে সেসব প্রকল্পের টাকা জামাল আহমদ চৌধুরীর ব্যাংক হিসাবে জমা হওয়া ও জামাল চৌধুরী গা ঢাকা দেয়ায় সাব-কন্ট্রাকটররা এখন টাকা পাচ্ছেন না।

এ অবস্থায় জামাল চৌধুরীর বিরুদ্ধে অন্তত ৭টি প্রতারণার মামলা হয়েছে। বুধবার সিলেট মহানগর আদালতে তিনি হাজির হলে বিচারক জিয়াদুর রহমান তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। শুদ্ধি অভিযান শুরুর পর সেপ্টেম্বরে ৭ দেহরক্ষী, নগদ প্রায় দুই কোটি টাকা ও ১৬৫ কোটি টাকার এফডিআরসহ জি কে শামীমকে ঢাকা থেকে গ্রেফতার করে র‌্যাব।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রকল্পের কাজ কোটি কোটি টাকা লাভে বিক্রি করে পকেটে পুরেই একাধিকবার শ্রেষ্ঠ করদাতার পুরস্কারও লাভ করেন জামাল চৌধুরী। জানা গেছে, প্রকল্পের টাকা তোলার সময় জামাল চৌধুরীর নামেই সাব-কন্ট্রাকটররা আয়করের টাকা জমা দেন সংশ্লিষ্ট দফতরে। সেই সুবাধে তিনি একাধিকবার হাতিয়ে নিয়েছেন শ্রেষ্ঠ করদাতার পুরস্কারটিও।

জামাল চৌধুরীর পাল্লায় পড়ে যারা এখন নিঃস্ব হওয়ার পথে সেই সাব কন্ট্রাকটররা হচ্ছেন- দিব্য দূতি দাস দিলু, উত্তম কুমার সরকার, রিপন আহমদ, কবির আহমদ, কামরুল ইসলাম। একই পথের পথিক ইঞ্জিনিয়ার সিদ্দিক হোসেন, সেলিম আহমদ, বাবলু মিয়া, ফরিদ আহমদ, তেরাব আলী, লুৎফুর রহমান খান ও আবুল কালাম আজাদসহ আরও অনেকেই। এদের মধ্যে ফরিদ আহমদ, মো. বাবলু মিয়া, তেরাব আলীসহ জামাল চৌধুরীর বিরুদ্ধে ৭টি প্রতারণা মামলা করেছেন।

এর মধ্যে দুটি মামলায় জামাল চৌধুরী উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে গা ঢাকা দিয়েছিলেন। ধার করে প্রকল্পের কাজ তুলে দেয়ার পর তাদের অনেকেই এখন পাওনাদারদের ভয়ে আত্মগোপনে চলে গেছেন।

জানা গেছে, সম্প্রতি বিদেশ যাওয়ার অভিপ্রায়ে প্রায় ৫ কোটি টাকার সম্পদ বিক্রি করে দিয়েছিলেন জামাল চৌধুরী। জানতে চাইলে ইঞ্জিনিয়ার সিদ্দিক হোসেন জানান, এর আগে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলী জাহিদুর রহমানের সময়ে হারিছ চৌধুরীর প্রভাবে জামাল চৌধুরীর উত্থান ঘটে।

২০০১-০৬ সাল পর্যন্ত হারিছ চৌধুরীর প্রভাবে টেন্ডারে ফন্টলোডিং স্ট্যাটেজির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। এজন্য ১/১১-এর সময় তার বিরুদ্ধে ১৬টি দুর্নীতি মামলাও হয়েছিল। অদৃশ্য কারণে থমকে আছে ওই মামলার কার্যক্রম।

হারিছ চৌধুরীর ভাই কানাইঘাট উপজেলা চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী বলেন, বন্ধু নয় ছোট ভাইয়ের মতো দেখি তাকে। বলতে পারেন বন্ধুর চেয়েও বেশি ঘনিষ্ঠ। হারিছ ভাইও জামাল আহমদ চৌধুরীকে খুব আদর করতেন।

জানা গেছে, গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আবিল আয়াম সুনামগঞ্জে যোগদানের পর নতুন কৌশলে অনিয়মে জড়ান জামাল চৌধুরী। তিনি নানা অজুহাতে সাব-কন্ট্রাকটরদের কাছ থেকে কাজ ফেরত নেন। পরে দেখা যায় আবিল আয়াম নিজেই ওইসব প্রকল্পের কাজ করছেন। রীতিমতো সাব-কন্ট্রাকটরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন আবিল আয়াম।

মেসার্স আক্তার টেড্রার্সের নামে বিল তুলে জমা রাখেন আবিল আয়ামের বিশ্বস্ত এক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে। এ সংক্রান্ত প্রমাণপত্র এ প্রতিবেদকের হাতে রয়েছে।

এর আগে কাজ শেষ না করেই ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর এ প্রকৌশলী প্রধানমন্ত্রীকে দিয়ে উদ্বোধন করিয়েছিলেন দক্ষিণ সুনামগঞ্জ, দোয়ারাবাজার থানা ভবন, শাল্লা ও জামালগঞ্জ ফায়ার সার্ভিস স্টেশন। এর মধ্যে থানা ভবন দুটি হস্তান্তর করা হয়নি, আর ফায়ার সার্ভিস স্টেশন দুটির কাজই শেষ হয়নি।

অথচ এসব কাজের জামানত পর্যন্ত তুলে নেয়া হয়েছে। এসব অনিয়মে আবিল আয়ামের সহযোগী হিসেবে রয়েছেন সহকারী প্রকৌশলী আবদুল ওদুদও। তারা দু’জনই এখন নিয়মিত ঠিকাদার বলে এলাকায় জনশ্রুতি রয়েছে।

এসব বিষয় অস্বীকার করে গণপূর্ত বিভাগ সুনামগঞ্জের সহকারী প্রকৌশলী আবদুল ওদুদ বলেন, সব কাজ তার প্রতিনিধিরা করছেন। আমরা এগুলো করছি না। এসবই মিথ্যা। গণপূর্ত বিভাগ সুনামগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী আবিল আয়াম যুগান্তরকে বলেন, আপনি অফিসে আসেন। ফোনে তো আর সবকিছু বুঝিয়ে বলা যায় না। এগুলো মিথ্যা।

জামাল চৌধুরীর যত সম্পদ

নিজের চলাচলের জন্য একটি পাজেরো, ৩টি ট্রাক, ২টি পিকআপ ভ্যান, ২টি মোটরসাইকেলের সন্ধান মিলেছে। এছাড়া ঢাকার সেগুনবাগিচার ‘নগর ছায়ানীড়’-এ আধুনিক ফ্ল্যাট। বিজয়নগর আকরাম টাওয়ারে বিশাল অফিস স্পেস।

সিলেটের আম্বরখানার গোল্ডেন টাওয়ারে ৪র্থ ও ৬ষ্ঠ তলায় ৬টি ফ্ল্যাট, ৩য় তলায় ৮টি অফিস স্পেস ও নিচ তলায় দোকান। এর বাইরে এয়ারপোর্ট এলাকার ধোপাগুলে কোটি টাকারও বেশি মূল্যের হাউজিং প্লট, আম্বরখানার বড় বাজারে প্রায় ২ কোটি টাকা মূল্যের ১২ ডিসিমিল জমি ও ৫০ লাখ টাকার পার্টনারশিপ লন্ডনে রেস্টুরেন্ট, বিভিন্ন ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট আছে প্রায় ৫ কোটি টাকা। ভাই সোলেমান আহমদ চৌধুরীকে সুবিদবাজারের কর্নারভিউয়ে ফ্ল্যাট কিনে দেয়া ছাড়াও ব্যবসার জন্য বড় অঙ্কের পুঁজিও দিয়েছেন।

দুঃসময়েও হারিছ চৌধুরীর পাশে আছেন জামাল চৌধুরী। জকিগঞ্জের মাইজগাঁওয়ের আবদুল মানিকের ছেলে আবদুল সালামের মাধ্যমে প্রায়ই হুন্ডির মাধ্যমে হারিছ চৌধুরীর কাছে টাকা পাঠান বলে অভিযোগ আছে। তবে আবদুল সালাম এটি অস্বীকার করে বলেছেন, জামাল চৌধুরী আমার বস। হারিছের কথা পেপার-পত্রিকায় শুনেছি। উনার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই।

জামাল চৌধুরীর কাছ থেকে প্রকল্পের কাজ ক্রয়কারী ঠিকাদাররা ও তার এসব অপর্কমের সাক্ষী হাফিজুল হক মাসুক এসব তথ্য নিশ্চিত করে যুগান্তরকে বলেন, উনাকে এসব কাজ ছেড়ে দেয়ার জন্য অনেক বোঝানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি।

নিজেও তার প্রতারণা ও টর্চার শেলে নির্যাতনের শিকার হয়েছি। তার সব অপকর্মের প্রমাণও ছিল আমার স্মার্টফোনে। পরে মোবাইলটিও তিনি নিয়ে গেছেন। পরে বাধ্য হয়ে তার বিরুদ্ধে মামলা করেছি। আমরা ন্যায়বিচার চাই।

এ ব্যাপারে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতর সিলেট জোনের নির্বাহী প্রকৌশলী নজরুল হাকিম জানান, জামাল চৌধুরীর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের একটি কাজ রয়েছে। তা বাতিল করার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। তবে বিএনপি সরকারের আমলে শিক্ষা প্রকৌশলের ৯০ ভাগ টেন্ডার তার প্রতিষ্ঠানগুলোর ছিল।

এলজিইডি সিলেট বিভাগের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী সেখ মোহাম্মদ মহসিন ও গণপূর্ত বিভাগের সিলেট সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. নুরুল আমিন মিয়া বলেন, আমাদের টেন্ডার ইজিপির মাধ্যমে হয়। এখানে অনিয়ম করার সুযোগ নেই। তবুও যদি কোনো প্রকৌশলী, কর্মকর্তা ও ঠিকাদার অনিয়মের আশ্রয় নিয়ে থাকেন এবং তা তদন্তে প্রমাণিত হলে তাদের বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়া হবে।

জামাল আহমদ চৌধুরীর স্ত্রী হোছনা আক্তার চৌধুরীর মোবাইলে একাধিকবার ফোন দেয়া হলেও তিনি ধরেননি। পরে খুদে বার্তা পাঠিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করা হলেও তাতে কাজ হয়নি।

তবে তার আইনজীবী এমআর খান মুন্না সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, জামাল চৌধুরীর বিরুদ্ধে যত মামলা বা অভিযোগ করা হয়েছে সব মিথ্যা। জাল চুক্তিপত্র বানিয়ে একটি চক্র ষড়যন্ত্রমূলক ভাবে এসব করছে। ইতিমধ্যে পিবিআই একটি মামলার রিপোর্ট দিয়েছে। ওই রিপোর্টে জামাল চৌধুরীর বিরুদ্ধে মামলার অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি।

এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, হারিছ চৌধুরীর সঙ্গে যোগযোগ রয়েছে কিনা এটা উনার ব্যক্তিগত বিষয়। এ ব্যাপারে কিছুই বলতে পারব না।

তথ্য সূত্রে : যুগান্তর

Sharing is caring!

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

বিজ্ঞাপন

আর্কাইভ

December 2019
S S M T W T F
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
28293031  

সর্বশেষ খবর

………………………..