সিলেট ১লা জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১৭ই আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ৫ই মহর্রম, ১৪৪৭ হিজরি
প্রকাশিত: ৩:৪৪ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ৫, ২০১৯
২০১৫ সালে শারপিন টিলার ক্ষতি নির্ণয়ের জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সেই কমিটি চুলচেরা বিশ্লেষণ করে যে রিপোর্ট দিয়েছিল সেখানে ওঠে এসেছিল শারপিন টিলায় আড়াই শ’ কোটি টাকার পাথর লুটের কথা। এর মধ্যে কেটে গেছে আরো ৪ বছর। এই চার বছরে সবচেয়ে বেশি পাথর লুটপাট করা হয়েছে। স্থানীয়দের মতে- এ ক্ষতির পরিমাণ এখন প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। ১৫ বছর আগে মাত্র এক বছরের লিজ নিয়ে শারপিনের ‘কুতুব’ মোহাম্মদ আলী নানা ফন্দি-ফিকির করে এই লুটপাট চালিয়েছে। আর এই লুটপাটে ইতিমধ্যে ঝরে গেছে অর্ধশতাধিক শ্রমিকের প্রাণও। হাইকোর্টের নির্দেশে সর্বশেষ গত ২৮শে জুলাই পর্যন্ত ‘বৈধতা’ দেখিয়ে শারপিন গিলে খেয়েছেন মোহাম্মদ আলী।
কিন্তু আদালতের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর এখন তিনি পুরোপুরি অবৈধ। এরপরও শারপিন টিলায় আগের মতো চলছে রয়্যালিটি আদায়। প্রতিদিন গড়ে ২০-২৫ লাখ টাকা রয়্যালিটি ‘ফাও’ খাচ্ছেন মোহাম্মদ আলী ও তার সিন্ডিকেট। এ ব্যাপারে প্রশাসন নীরব। ভাগ যায় সবার ঘরে। এ কারণে কেউ-ই প্রতিবাদ করছেন না। সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের শারপিন টিলা। শাহ আরেফিন (রহ.) মাজার এই টিলায়। ১৩৭ একর ভূমির এই টিলা এক সময় ছিল পর্যটন কেন্দ্র। মাজারে যেত অসংখ্য মানুষ। ঘুরে দেখতো প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। কিন্তু পুরো টিলাটাই হচ্ছে পাথরময়। আশপাশের দুই কিলোমিটার এলাকাজুড়ে পাথরের রাজ্য। কোম্পানীগঞ্জের স্থানীয় মানুষ ওলির মাজার হিসেবে ওই টিলাকে সংরক্ষণ করে রেখেছিল। কিন্তু ২০০৪ সালে এই টিলার ওপর নজর পড়ে পার্শ্ববর্তী কাঠালবাড়ি গ্রামের জিয়াদ আলীর ছেলে মোহাম্মদ আলীর। দাদার আমল থেকে উপজেলা সদরের কাঠালবাড়িতে তাদের বাস। এর আগে তাদের জন্মভূমি ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। পরিবেশ অধিপ্তরের গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্ট থেকে জানা গেছে- মোহাম্মদ আলী প্রথমে রক্ষণা-বেক্ষণের কথা বলে মাজার কমিটির সঙ্গে একটি লিখিত চুক্তি করেন। পরবর্তীতে খনিজ উন্নয়ন ব্যুরো থেকে মোহাম্মদ আলী তার দাদা বশির আহমদের নামের সৃজন করা বশির কোম্পানির নামে ২০০৪ সালের ৪ঠা এপ্রিল এক বছরের জন্য লিজ নেন। খনিজ উন্নয়ন ব্যুরো স্থানীয় চিকাঢর মৌজার ২৫ হেক্টর ভূমি লিজ দিয়েছিল। পরবর্তীতে ৫ মাসের মাথায় মোহাম্মদ আলীর অবাধ লুটপাটের বিষয়টি নজরে আসায় ফের খনিজ উন্নয়ন ব্যুরো সেই লিজ বাতিল করে দেন। এরপরও মোহাম্মদ আলী নানা কায়দায় শারপিন টিলায় পাথর উত্তোলন অব্যাহত রাখে। আর সেই পাথর থেকে প্রতিদিন ২০-২৫ লাখ টাকা আদায় করে আসছে। এতদিন গোপনে গোপনে শতকোটি টাকার পাথর লুট করলেও ২০১৩ সালে একের পর এক শ্রমিক মৃত্যুর মিছিল শুরু হওয়ায় শারপিন টিলা নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়। সবার নজরে আসে শারপিন টিলা। ততদিন প্রায় ১৩৭ একর টিলার অস্বিত্ব বিলীন হয়ে গেছে। লোপাট করা হয়েছে গোটা টিলা। শতাধিক ফুট ওই টিলা কঙ্কালসার হয়ে পড়েছিল। পরিবেশবাদীরা এ নিয়ে আদালতের দ্বারস্থ হন। এর মধ্যে ২০১৫ সালে পরিবেশ অধিদপ্তরের মহা-পরিচালকের নির্দেশে শারপিন টিলার ক্ষতি নিরূপনে একটি কমিটি গঠন করা হয়। সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের (রাজস্ব) নেতৃত্বে গঠিত কমিটিতে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক, ভূতাত্ত্বিক ও ভূমি জরিপ অধিদপ্তরের পরিচালক, খনিজ উন্নয়ন ব্যুরো একজন উপপরিচালক সহ স্থানীয় মাজার কমিটির সভাপতিও ছিলেন। ওই বছরের শেষের দিকে গঠিত কমিটি বশির কোং-র মালিক আলোচিত মোহাম্মদ আলীর বিরুদ্ধে আড়াই শ’ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণের অভিযোগ আনেন। লিখিত তদন্তে তারা উল্লেখ করেন- মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে ১৩৭ একর ভূমির ৭০ ভাগই ইতিমধ্যে কর্তন করা হয়েছে। প্রায় ৩০ ফুট উচ্চতা সম্পন্ন টিলা ধ্বংস করা হয়েছে। তারা উল্লেখ করেন- ৪০ টাকা দরের প্রায় ৬৩ লাখ ঘনফুট পাথর লুটপাট করা হয়েছে। এর মূল্য ২৫১ কোটি টাকা। তদন্ত প্রতিবেদন পরিবেশ অধিদপ্তরে পাঠানো হয়। এই রিপোর্টের পর সিলেটের জেলা প্রশাসন থেকে কোম্পানীগঞ্জের পাথরখেকোদের ৪৮ জনের একটি তালিকা প্রকাশ করে। এই তালিকায় থাকা পাথরখেকোরা হাজার হাজার কোটি টাকার পাথর লুটপাট করেছে। এদিকে- এই প্রতিবেদনের আগেই খনিজ উন্নয়ন ব্যুরো থেকে সিলেটের জেলা প্রশাসনকে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়ে একটি পত্র দেয়া হয়েছিল। পরিচালক মঈন উদ্দিন আহমদ ওই পত্রে উল্লেখ করেন- মেসার্স বশির কোম্পানির প্রোপাইটার মোহাম্মদ আলী ২৫ হেক্টর এলাকার সাধারণ পাথর মহালের ২০১৩-২০১৪ ও ২০১৪-২০১৫ সালের রয়্যালিটি বাবদ প্রায় ৪ লাখ টাকা সরকারি চালানের মাধ্যমে কোষাগারে জমা দিয়েছেন। এর থেকে প্রতীয়মান হয় মোহাম্মদ আলী কোয়ারিতে কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন।
এ ব্যাপারে বেলার রিটের প্রেক্ষিতে আদালতের স্থিতাবস্থা রয়েছে বলে নির্দেশনায় উল্লেখ করা হয়। এজন্য কোয়ারির কার্যক্রম বন্ধ রাখতে জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু এই আদেশ প্রাপ্তির পরও সিলেটের জেলা প্রশাসন থেকে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। বিভিন্ন সময় আদালতের নির্দেশনা দেখিয়ে মোহাম্মদ আলী শারপিন টিলা থেকে রয়ালিটি আদায় অব্যাহত রাখেন। একই সঙ্গে তার নেতৃত্বে পাথরখেকো অবাধে লুটপাট চালিয়ে গোটা টিলাকে ইতিমধ্যে ধ্বংস করে ফেলেছে। এখন সেটি সমতল ভূমিতে পরিণত হয়েছে। এই অবস্থায় গত ২৮শে জুলাই হাইকোর্টের একটি নির্দেশনার মেয়াদ শেষ হয়েছে। এরপর থেকে ‘ফাও’ খাচ্ছেন মোহাম্মদ আলী। পাড়ুয়া লামাগ্রামের বাসিন্দা ও কোম্পানিগঞ্জ আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি রফিকুল হক আদালতের নির্দেশনার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর সিলেটের জেলা প্রশাসক, বিভাগীয় প্রশাসন, মন্ত্রণালয়, দুর্নীতি দমন কমিশনে একাধিক পত্র দিয়েছে। এসব পত্রে তিনি প্রশাসনিক ব্যবস্থা দাবি জানান।
Sharing is caring!
………………………..
Design and developed by best-bd