হাত বাড়ালেই যৌন উত্তেজক সিরাপ : খেলেই মৃত্যু, নকল বিএসটিআই’র সিল

প্রকাশিত: ১০:০০ অপরাহ্ণ, জুলাই ১১, ২০১৯

হাত বাড়ালেই যৌন উত্তেজক সিরাপ : খেলেই মৃত্যু, নকল বিএসটিআই’র সিল

দেশের এমন শহর নেই যেখানে হাত বাড়ালেই পাওয়া যায় না যৌন উত্তেজক সিরাপ। শুধু শহরই নয়, পাড়াগায়ের ছোট ছোট বাজার এবং দোকানগুলোতেও অবাধে বিক্রি হয় শরীরের জন্য মারত্মক ক্ষতিকার এসব সিরাপ। এসব সিরাপের বোতলের গায়ে বিএসটিআই (বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস এন্ড টেস্টিং ইন্সটিটিউশন)-এর ট্রেডমার্ক সিল থাকলেও কর্তৃপক্ষের বক্তব্য- এসবের কিছুই তারা জানেন না। অথচ যত্রতত্র পাওয়া যাচ্ছে বিএসটিআই এর সিল সংবলিত এসব ক্ষতিকর সিরাপ।

জানা গেছে, সারাদেশ জুড়েই অবাধে বিক্রি হচ্ছে যৌন উত্তেজক সিরাপ। নানা লোভনীয় নামে বিভিন্ন ব্রান্ডের এসব সিরাপের প্রতি আসক্তি বাড়ছে বিভিন্ন বয়সী ছাত্রছাত্রী, তরুণ-তরুণীদের মধ্যে। অনেকে ইয়াবার বিকল্প হিসেবে শরীরের উত্তেজনা বাড়াতেও এসব সিরাপ পান করছেন। শহর-বন্দরের আনাচকানাচে, অলিগলিতে যেকোনো দোকানে হাত বাড়ালেই মিলছে বিভিন্ন নামের যৌন উত্তেজক সিরাপ। প্রশাসনের চোখের সামনেই ডিপার্টমেন্টাল স্টোর থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত অলিগলির ছোট ছোট দোকানেও প্রকাশ্যে বিক্রি হচ্ছে এসব সিরাপ। সিরাপগুলো হচ্ছে- বি-জিনসিন , জিনসিন প্লাস, জিন্টার, হর্স ফিলিংস, লিডার, রচিতা, মুন পাওয়ার ফিলিংস, ভিগো-বি , ম্যান পাওয়ার (স্বচ্ছ তরল), ম্যান পাওয়ার (অস্বচ্ছ তরল), হর্স ফিলিংস, রয়েল টাইগার, ব্ল্যাক হর্স ও স্পিড অ্যাকটিভ পাওয়ার ফিলিংস, জাদু ইত্যাদি।

বিশেষভাবে কয়েকটি কোম্পানীর এসব ক্ষতিকর ড্রিংকস বাজারে বেশি পাওয়া যায়। এর মধ্যে ‘ফাস্ট কিংস আপ ফ্রুট সিরাপ’ নামের একটি সিরাপে মানবশরীরের জন্য খুবই ক্ষতিকর উপাদান রয়েছে বলে জানা গেছে। এই সিরাপটি ‘ফাস্ট ফুড (H.BD) ইন্ডাস্ট্রিজ প্রা. লি.’ নামে একটি কোম্পানি বাজারজাত করে। এই কোম্পানীর অফিস হচ্ছে পাবনার হেমায়েতপুরের আফুরিয়ার চৌরাস্তার মোড়ে। এই কোম্পানির ১১০ মিলি’র সিরাপের বোতলের গায়ে সিরাপের উপাদান হিসেবে উল্লেখ রয়েছে- ফলের নির্যাস, সুগার, লিকুইড গ্লুকোজ, সাইট্রিক এসিড, স্যাফ্রন, সোডিয়াম বেনজোয়েট, পারমিটেড ফুড কালার। বোতলের গায়ে রয়েছে নাম্বারসহ বিএসটিআই-এর একটি ট্রেড সিলও।

এদিকে বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সিরাপে বিদ্যমান ১৮৮ দশমিক ২৫ মিলিগ্রাম ক্যাফেইন ও ১২৬ দশমিক ৮০ মিলিগ্রাম সিলডেনাফিল যৌন উত্তেজক ভায়াগ্রার প্রধান উপাদান। এটি পান করার পর তাৎক্ষণিক যৌন উত্তেজনার সৃষ্টি হয় এবং কয়েকদিন পর্যন্ত শরীরে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে। এটি পান করলে গ্যাসট্রিক ও হার্টবিট বেড়ে যায়। অন্যান্য খাদ্য খাওয়ার কোনো রুচি থাকে না। পেট ব্যথা করে। ভায়াগ্রামিশ্রিত এ সিরাপ পান করলে গর্ভবতী নারীর গর্ভপাতও হয়ে যেতে পারে। হৃদরোগীর তাৎক্ষণিকভাবে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুও হয়ে যেতে পারে।

এদিকে, সিলেটে এই প্রাণহানীকর সিরাপের পরিবেশক হচ্ছেন নগরীর লালদিঘীর পারের শাহজাহান। তিনি লালদিঘিরপারস্থ আঞ্জুমান স্টোরের প্রোপ্রাইটর। তার মাধ্যমে সিলেট বিভাগের আনাচে-কানাচে প্রতিদিন প্রায় ২০ লক্ষ টাকার প্রাণঘাতি সিরাপ বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ পান করে বলে জানা গেছে।

এ বিষয়ে ‘ফাস্ট ফুড (H.BD) ইন্ডাস্ট্রিজ প্রা. লি.’ এর এমডি আব্দুর রাজ্জাকের মোবাইল ফোনে কল করে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইলে তিনি কোনো ধরনের বক্তব্য দিতে অসম্মতি প্রকাশ করেন এবং তাৎক্ষণিক ফোনের লাইন কেটে দেন।

অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, এসব সিরাপ ২০ থেকে ৮০ টাকার মধ্যে পাওয়া যায়। যার ফলে যে কেউ কিনতে পারছে সহজেই। দাম কম এবং সংগ্রহ সহজ হওয়ায় বিভিন্ন স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরা অবাধে এসব সিরাপ পান করে আসক্ত হয়ে পড়ছে। এমনকি বিভিন্ন হোটেলের ভেতর স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীসহ বিভিন্ন বয়সের তরুণ-তরুণীরা এসব ড্রিংকস পান করে নানা অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত হচ্ছে। এসব সিরাপ পানের কু-প্রভাবে সমাজে যৌনাচার, ব্যভিচার, ধর্ষণ, ইভটিজিংসহ বিভিন্ন অপরাধমুলক কর্মকা আশংকাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু বিএসটিই, প্রশাসন বা ভ্রাম্যমাণ আদালতের পক্ষ থেকে কেনো প্রকার নজরদারী করা হচ্ছে না। প্রশাসনের নীরবতার সুযোগে যৌন উত্তেজক এসব পানিয় পানের ফলে যৌন অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধির পাশাপাশি জনস্বাস্থ্যের মারাত্মক বিপর্যয় ঘটছে। চিকিৎসকদের মতে, এনার্জি ড্রিংকস নামে যেসব পানীয় বিক্রি হচ্ছে, তা হচ্ছে সাময়িক উত্তেজনা সৃষ্টিকারী পানীয়। এর মধ্যে রয়েছে অ্যালকোহল (মদ)। বোতলজাত বা টিনজাত উপাদানের তালিকায় এই অ্যালকোহলের আধুনিক নাম দেওয়া হয়েছে ‘এনার্জি’। এগুলো পান করার পর শরীরে সাময়িকভাবে ভিন্ন ধরনের উত্তেজনা সৃষ্টি করে। যারা নিয়মিত খায় তারা ধীরে ধীরে এতে আসক্ত হয়ে পড়ে। এসব সিরাপ নিয়মিত পান করলে কিডনি, লিভার, ফুসফুসসহ অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গে নানা জটিল রোগ সৃষ্টি হয়। এসব সিরাপ মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ভিগো-বি , ম্যান পাওয়ার (স্বচ্ছ তরল), ম্যান পাওয়ার (অস্বচ্ছ তরল), হর্স ফিলিংস, রয়েল টাইগার, ব্ল্যাক হর্স ও স্পিড নামের সাতটি পানীয়তে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর উপাদান রয়েছে। পানীয়গুলোর মধ্যে প্রথম চারটিতে ‘অপিয়াম অপিয়েট’ ও ‘সিলডেনাফিল সাইট্রেট’ নামের রাসায়নিক দ্রব্য পাওয়া গেছে। এ দুটি দ্রব্য ‘ওষুধ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ, ১৯৮২’ অনুযায়ী নিষিদ্ধ। পরের তিনটি পণ্যে পাওয়া গেছে উচ্চমাত্রার ক্যাফেইন।

এ বিষয়ে বিএসটিআই (বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস এন্ড টেস্টিং ইন্সটিটিউশন)-এর মহাপরিচালক মো. মুয়াজ্জেম হোসাইনের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি। তার পরিবর্তে এ বিষয়ে বক্তব্য দেন ডেপুটি ডিরেক্টর মো. রিয়াজুল হক। তিনি এ বিষয়ে বলেন, এসব সিরাপের বিষয়ে আমাদের কিছু করার নেই। কিন্তু এসব সিরাপের বোতলে বিএসটিআই- এর সিল থাকে কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এসব সিল নকল।

বিশিষ্টজনদের মতে, যারা অনুমোদনবিহীন এ যৌন উত্তেজক পানীয় তৈরী করছে এবং বিক্রি করে যুব সমাজকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে তারা দেশও জাতির শত্র“, তাদেরকে আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি প্রধান করা উচিৎ।

Sharing is caring!

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

বিজ্ঞাপন

আর্কাইভ

সর্বশেষ খবর

………………………..