গাছকে কেন্দ্র করে তুফান পীরের মাজার তৈরী : জ্বলছে আগোরবাতি, মোমবাতি

প্রকাশিত: ৭:৩২ অপরাহ্ণ, মে ২৪, ২০১৯

গাছকে কেন্দ্র করে তুফান পীরের মাজার  তৈরী : জ্বলছে আগোরবাতি, মোমবাতি

পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জে ঝড়ে পড়ে যাওয়া একটি গামার গাছকে কেন্দ্র করে তুফান পীরের মাজার গড়ে তোলা হয়েছে। কাগজে লিখে দেওয়া হয়েছে নিয়ত করলে ফল মিলবে। অন্ধ বিশ্বাসে অনেকে মানত করতে শুরু করে দিয়েছে। মাজারে জ্বলছে আগোরবাতি, মোমবাতি। টাকা পয়সা, গোলাপ জল, আগোরবাতি পড়ছে প্রতিনিয়ত। এ যেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর লালসালুরই একবিংশ শতকের নতুন সংস্করণ।

জেলার দেবীগঞ্জ উপজেলার সোনাহার মল্লিকাদহ ইউনিয়নের গজপুরী গ্রামে গত ১৭ মে ভোরে ঝড়ো বাতাসে ওই এলাকার সাবেক গ্রাম সরকার তোফাজ্জল হোসেনের দুটি বড় আকৃতির গামার গাছ পড়ে যায়। গামার গাছ স্থানীয়ভাবে পিঠালি গাছ নামে পরিচিত। একটি গাছ পাশের রাস্তার উপর পড়লে রাস্তাটি বন্ধ হয়ে যায়। পরে গাছের মালিক তাৎক্ষণিক গাছটি স্থানীয় কাঠ ব্যবসায়ী বাবুল হোসেনের কাছে বিক্রি দেন এবং কাঠুরিয়া দিয়ে দ্রুত গাছটি কেটে নিয়ে যেতে বলেন। কাঠুরিয়ারা প্রথমে সড়কের উপরে থাকা গাছের ডালপালা কেটে দেয়। ডালপালা কাটার পর গোড়ালির ভর বেশি হওয়ায় গাছটি নিজে থেকেই আবার আস্তে আস্তে আগের মতো দাঁড়িয়ে যায়। ওই গাছটি ৫/৬ বছর আগেও আরেক বার একইভাবে পড়ে গিয়ে উঠে যায়। গোঁড়ালির মাটির ভরের কারণে গাছটি উঠে গেলেও স্থানীয় একটি চক্র গুজব ছড়িয়ে দেয় গাছের অলৌকিক ক্ষমতার।

এরপর কাঠুরিয়ারা ভয়ে গাছ কাটা বন্ধ করে বাড়ি চলে যায়। এই কথা দশ কান পর্যন্ত পৌঁছাতেই রাতারাতি ওই এলাকার মোবারক হোসেনের ছেলে ইসমাইল হোসেন লালসালু এনে তা মাজারের আদলে ঘেরাও করে তুফান পীরের মাজার হিসেবে ঘোষণা দিয়ে মুরিদ ও খাদেম বনে যায়। তার যোগ হয় গ্রামের আরও কিছু মানুষ।

স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা মামুন শাহ তার ফেসবুকে ‘দুইশ বছরের আগের পীরের সন্ধান, উপরে পড়া গাছকে বার বার জীবন্ত করে’ শিরোনাম দিয়ে প্রচারও করেন। এরপর আর দশটি মাজারের মতই ওই গামার গাছের প্রাঙ্গন হয়ে উঠে তুফান পীরের মাজার হিসেবে। সেখানে লিখে দেয়া হয় নিয়ত করলে ফল মিলবে। এরপর দূর দূরান্ত থেকে মানুষরা মাজার দেখতে আসতে থাকে। টাকা পয়সা দান দক্ষিণা করার পাশাপাশি মাজারে মোমবাতি, আগোবাতি জ্বালানো হয়। এছাড়া কেও দুধ ঢেলে মানত করে যাচ্ছেন বলেও জানান স্থানীয়রা। দানে পড়া টাকা ওই চক্রটিই হাতিয়ে নিচ্ছে। দিন দিন তারা মাজারটি শক্তভাবে স্থাপন করার প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছে।

বুধবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, দেবীগঞ্জের সোনাহার ইউনিয়নের বটতলী বাজার থেকে গজপুরী গ্রামের সড়ক ধরে কয়েকশ মিটার সামনে গেলেই দেখা মিলল কথিত তুফান পীরের মাজার। কবরের আদলে লাল কাপড় দিয়ে ঘেরা দেয়া গাছটি। ভেতরে ভক্তদের দেয়া কয়েকটি পয়সা পড়ে আছে। তার সাথে আগোরবাতি, মোমবাতি ও গোলাপজলের বোতল পড়ে আছে। গাছটিতে লাল কাপড়ের উপর রঙিন প্রিন্টে কম্পোজ করা কাগজ আটকিয়ে দেয়া আছে। সেখানে লেখা আছে ‘নিয়ত করলে, ফল পাবেন’। কে এই তুফান তার কোন পরিচয় দিতে পারলেন না স্থানীয় কেও। কেও কেও বললেন তুফান হলেই এই গাছ অলৌকিক ক্ষমতা দেখায় তাই তুফান পীরের মাজার নাম রাখা হয়েছে। সেখানে কোন খাদেমকেও পাওয়া গেলো না। তবে উৎসুক কিছু মানুষের ভিড় দেখা গেলো। যারা এক পলক ওই অলৌকিক ক্ষমতার গাছটি দেখতে এসেছেন। কেও কেও আবার টাকাও ফেললেন। এ যেন আধুনিক যুগের আরেক লালসালু। তবে ব্যবধান হলো স্থানীয়দের অল্প ক’জন বাদে সবাই এই মাজারের বিপক্ষে।

স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেলো ঝড়ে গাছটি পড়ে গিয়ে আবার উঠে যাওয়ার পরপরই হিন্দু ধর্মালম্বীরা তাদের দেবতা ভেবে পূজা অর্চনা শুরু করে। এরপর স্থানীয় যুবক ইসমাইল হোসেনসহ কয়েক সেখানে মুসলমানদের পীরের মাজার রয়েছে বলে জানিয়ে তাদেরকে বাঁধা দিয়ে তুফান পীরের মাজার ঘোষণা দেয়।

তারা আরও জানায়, ওই স্থানে কখনো কোন মাজার ছিলো না। স্থানীয়দের কোন কবরও ছিল না। সেটিকেই এখন মাজার বানানোর চেষ্টা চলছে। মাজারের প্রতি দুর্বল মানুষরা প্রতিদিন ছুটে আসছে এখানে। দ্রুত এই কথিত তুফান পীরের মাজার স্থাপন বন্ধ করা না গেলে অনেক মানুষ প্রতারিত হবে বলে মনে করছেন তারা। তারা প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই এলাকার হিন্দু গৃহবধূ জানান, আমি গাছের পাশেই কাজ করছিলাম। গাছটি নিজে থেকেই উঠে গেলে ইসমাইল আমার কাছে লাল কাপড় চাইলো। আমি দেই নি। পরে সে কোথা থেকে যেন একটা লাল কাপড় এনে ঘেরা দিলে আর একটা বস্তা বিছিয়ে দিলো। তারপর থেকেই টাকা পয়সা পড়তে শুরু করলো।

প্রত্যক্ষদর্শী কাঠুরিয়া জাকিরুল ইসলাম জানান, গাছটির গোঁড়ালিতে অনেক মাটি ছিল। আমরা ডালগুলো কেটে দেয়ার পরেই গাছটি আবার দাঁড়িয়ে যায়। এরপর আমরা চলে যাই। পরে এসে দেখি লাল কাপড় দিয়ে ঘেরা দিয়ে তুফান পীরের মাজার করা হয়েছে। মানুষ দূর দূরান্ত থেকে এসে মানত করতেছে টাকা পয়সা দিচ্ছে।

দেবীগঞ্জ ডিগ্রি কলেজের ছাত্র ছাইফুল ইসলাম জানান, আমি প্রতিদিন এই রাস্তা ধরে কলেজে যাই। গাছের যেদিকে ভর থাকবে গাছতো সেদিকেই যাবে এটাই স্বাভাবিক। আমাদের এলাকার এক শ্রেণির মানুষ লাভের আশায় মানুষকে প্রতারিত করার জন্যই মাজার ব্যবসা শুরু করেছে। এটা অবিলম্বে প্রশাসনের বন্ধ করা উচিত।

স্থানীয় কৃষক কাবিরুজ্জামান জানান, গাছটি পড়ে গিয়ে আবার উঠে যাওয়ার পর গাছের অলৌকিক ক্ষমতার কথা ছড়িয়ে যায়। কেউ বলে ভূত আছে, কেও বলে দেবতা আছে, কেও বলে সাপ আছে। একটা নাটক শুরু করে দেয় তারা। এখন দেখি মাজার হয়ে গেছে। অনেক মানুষ আসতেছে দান করতেছে। তবে দানের টাকা রাতে কে যেন নিয়ে যায়।

ওই এলাকার বৃদ্ধ ওমর আলী বলেন, আমি এখানে ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বসবাস করে আসছি। কখনো শুনিনি এখানে মাজার আছে। গাছ পড়ে দাঁড়িয়েছে গোড়ালিতে ভার বেশি ছিলো তাই। কিন্তু এখন মাজার বানিয়ে ফেলেছে। অনেকে টাকা পয়সাও দান করতেছে।

ঠাকুরগাঁও থেকে আসা ট্রাক চালক মানিক জানান, গাছটি নিজে থেকেই উঠে দাঁড়িয়েছে শুনে দেখতে আসলাম। এখন বোঝাই যাচ্ছে না গাছটি পড়ে গেছিল। আসলেই বিষয়টি রহস্যজনক।

গাছের মালিক তোফাজ্জল হোসেন বলেন, আমি তো গাছটি বিক্রি করে দিয়েছি। কিন্তু কাঠুরিয়ারা ভয়ে কাটছে না। এখানে কে লালসালু দিয়ে মাজার করেছে তাও বলতে পারি না। তবে এখানে মাজার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হলে আমরা তা মেনে নিবো না।

সোনাহার ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মামুন শাহ জানান, কিছু দুষ্ট ছেলের কাজ এটা। তবে কিছু মানুষ এসব বিশ্বাস করে। এখানে যেন মাজার হতে না পারে আমরা সেটাই চেষ্টা করবো। তবে ফেসবুকে কেন প্রচার করেছিলেন এমন প্রশ্নের তিনি কোন উত্তর দিতে পারেননি।

মাজারের কথিত খাদেম ইসমাইল তুফান পীরের মাজার ঘোষণায় তার জড়িত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেন।

দেবীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা প্রত্যয় হাসান বলেন, তুফান পীরের মাজার নাম দিয়ে একটি গাছকে কেন্দ্র করে স্থানীয় কিছু কুসংস্কারাচ্ছন্ন লোক ব্যবসায়িক কিংবা অন্ধ বিশ্বাসে মাজারের রূপ দেয়ার চেষ্টা করছে। এ বিষয়ে আমরা পুলিশ প্রশাসন ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সাথেও কথা বলেছি। আমরা প্রথমে স্থানীয়দের সচেতন করে কথিত মাজার প্রতিষ্ঠা থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করবো। তবে তারপরও যদি তারা সরে না আসে তাহলে শক্তি প্রয়োগ করে হলেও মাজার প্রতিষ্ঠা বন্ধ করা হবে।

Sharing is caring!

বিজ্ঞাপন

আর্কাইভ

সর্বশেষ খবর

………………………..