সিলেট ৫ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২০শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ২রা জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি
প্রকাশিত: ৬:৫২ অপরাহ্ণ, মার্চ ১৩, ২০১৯
সিলেট :: মানুষের যাপিত জীবনে থাকে বর্তমানে আধিক্য এবং একই সাথে থাকে ভবিষ্যতের স্বপ্ন-সাধনা । যার কারণে অনেক সময় চাপা পড়ে যায় অতীত ও ইতিহাসের বহুমাত্রিক সাংস্কৃতিক নিদর্শন। দেখার ভেতর থাকে অদেখা ভুবন, প্রদীপের নীচে থাকে অন্ধকার। তাই অনেক সময় অতীতকে, অতীতের ইতিহাসকে, আর ইতিহাসের নানান স্মারক, নির্দশন ও স্থাপনার কথা মানুষ ভুলে যায় । মূল্যহীন ভেবে সেগুলোকে ফেলে রাখে অযতেœ, অবহেলায়। কখনো সেগুলোকে ধ্বংসের উল্ল্যাসে মেতে উঠে অবিবেচক মানুষ। সিলেটের জ্যোর্তিময় সাংস্কৃতিক নিদর্শন ’আবুসিনা ছাত্রাবাস ভবন’ সেরকমই ইতিহাসের এক মূল্যবান স্মারক যেটিকে ভেঙ্গে ফেলার আয়োজন চুড়ান্ত করা হয়েছে। ইতিহাসের এ মণিমুক্তোকে সংরক্ষণ না করে ভেঙ্গে ফেলা হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাঠগড়ায় সবাইকে একদিন দাঁড়াতে হবে। সৃষ্টির জন্য ধংশ অনিবার্য শর্ত নয়।
ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা ‘আবুসিনা ছাত্রাবাস ভবন’ সংরক্ষণ করে যাদুঘর প্রতিষ্ঠার দাবিতে আয়োজিত ’প্রতিবাদী অবস্থান কর্মসূচি’তে বক্তারা এ কথা বলেন। হেরিটেজ নিয়ে কর্মরত সংগঠন ’সেভ দ্য হেরিটেজ এন্ড এনভায়রনমেন্ট’র উদ্যোগে বুধবার বিকাল ৪ ঘটিকায় আবুসিনা ছাত্রাবাস প্রাঙ্গনে এ কর্মসূচি পালিত হয় । আগের দিন মঙ্গলবার বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন-বাপা সিলেট কেন্দীয় শহীদ মিনারে মানব বন্ধন কর্মসূচি পালন করে।
সংগঠনের প্রধান সমন্বয়কারী আব্দুল হাই আল হাদী’র সঞ্চালনায় ও সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ কর্মসূচিতে “আবু সিনা ছাত্রাবাস সংরক্ষণ ও বিভাগীয় যাদুঘর প্রতিষ্ঠার আন্দোলন”-এর প্রেক্ষাপট তুলে ধরে সুচনা বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেট শাখার সাধারণ সম্পাদক ও নাগরিক আন্দোলনের সংগঠক আব্দুল করিম কিম । অন্যানের মধ্যে বক্তব্য রাখেন ভাষা সৈনিক মতিন উদ্দিন যাদুঘরের পরিচালক ডা: মোস্তফা শাহ জামান চৌধুরী বাহার, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের বিভাগীয় প্রধান স্থপতি শুভজিৎ চৌধুরী, জালালাবাদ এসোসিয়েশন ঢাকা’র কোষাধ্যক্ষ ইমাম মেহেদী এনাম, সিলেট সাইক্লিং কমিউনিটি’র সভাতি আরীফ আক্তারুজ্জামান, গণজাগরণ মঞ্চ সিলেটের মুখপাত্র দেবাশীষ দেবু, ইমজা’র ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শামছুল ইসলাম শামীম, সাংবাদিক প্রত্যুষ তালুকদার, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেট শাখার যুগ্ম সম্পাদক ছামির মাহমুদ, স্থাপত্য সংঘ শাবিপ্রবি-এর সহ সভাপতি সুমন পাল, মনির হোসেন আকাশ, আবু তাহের শোয়েব প্রমুখ । কর্মসূচীতে এসে একাত্বতা প্রকাশ করেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যায় ও লিডিং বিশ্ববিদ্যায়ের স্থাপত্য বিভাগের শিক্ষার্থীবৃন্দ, পরিবর্তন চাই, ঐশি’র নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন।
‘আবু সিনা ছাত্রাবাস’ নামের ভবনটির স্থাপত্য মূল্য ও ভবনটির বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ মতামত ব্যাক্ত করে বক্তব্য রাখেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগীয় প্রধান স্থপতি শুভজিৎ চৌধুরী ।
প্রায় দেড় ঘন্টাব্যাপী অবস্থান কর্মসূচির ফাঁকে ফাঁকে বক্তারা তাদের মতামত ও দাবির কথা তুলে ধরেন।
সভায় বক্তারা বলেন, সিলেট শুধু একটি নগর নয় কিংবা নয় কেবল একটি অঞ্চল । সিলেট নানান ইতিহাসের এক সূতিকাগার, বৈচিত্র্যময় সং¯ৃ‹তির কুঁড়েঘর, বৈচিত্র্যময় ধর্ম-দর্শনের কারখানা, সূফি-দরবেশের চারণভূমি, বহুমাত্রিক সুর-সংগীতের বারামখানা, আর নানা ঐতিহাসিক ও প্রাগৈাতিহাসিক পুরাকৃর্তি ও প্রত্মসম্পদের অন্তহীন এক সা¤্রাজ্য। সে প্রতœ-সা¤্রাজ্যের এক ক্ষুদ্র অংশ হচ্ছে ’আবুসিনা ছাত্রাবাস ভবন’।
বক্তারা বলেন, প্রগৈতিহাসিক কাল হতে বর্তমান সময় পর্যন্ত সিলেটের রয়েছে এক গৌরবগাঁথা ইতিহাস । সে ইতিহাসের বস্তুগত উপাদান এখনও অনেক জায়গায় দেখতে পাওয়া যায়। মেগালিথিক স্থাপনা তার অনন্য নিদর্শন। এখানকার নৈসর্গিক সৌন্দর্য, প্রাকৃতিক সম্পদ, ভূতাত্তি¡ক আনুকুল্যের কারণে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এ অঞ্চলে মানুষের আগমণ-নির্গমণ ঘটেছে । সে সব মানুষেরা এখানে সভ্যতার বিকাশ ঘটিয়েছিল এবং সেসবের নিদর্শনগুলো আজও সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে। ইতিহাসের সে স্থান, স্থাপনা ও নিদর্শনগুলো রক্ষা করা সবার নাগরিক দায়িত্ব।
বক্তারা আরও বলেন, সিলেট ভূমিকম্প প্রবণ ও বৃষ্টিবহুল এলাকা হওয়ায় ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো বিভিন্ন সময়ে ধ্বংস হয়েছে । এ অবস্থায় নগরীর কেন্দ্রস্থলে ইংরেজী ’ইউ’ আদ্যাক্ষারের আদলে নির্মিত দেড়শ বছর প্রাচীন ’আসাম টাইপ স্থাপত্য রীতির’ এই ভবন ভেঙ্গে ফেলার পরিকল্পনা কিছুতেই বুদ্ধিমানের কাজ হবেনা । অবিলম্বে এই পরিকল্পনা বন্ধ করতে হবে । এই স্থাপনা সংরক্ষণ করে সিলেট বিভাগীয় যাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা এবং প্রস্তাবিত ২৫০ শয্যার হাসপাতাল পাশ্ববর্তী উন্মুক্ত স্থানে কিংবা শহরতলীর টুকেরবাজার, বাদাঘাট বা অন্য কোথাও করার আহŸান জানানো হয়। নবপ্রতিষ্ঠিত সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যাল এ ভবনটিকে জাদুঘর হিসেবে ব্যবহার করতে পারে বলেও সভায় প্রস্তাব
আয়োজকদের পক্ষ থেকে বলা হয়, বাংলাদেশ পুরাকীর্তি আইন ১৯৬৮ অনুযায়ী এটি ভাঙ্গা সম্পূর্ণ বেআইনী। বাংলাদেশের প্রতœতত্ত¡ আইনে বলা আছে, কোনো ভবন বা স্থাপনা মূলত সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক বা ব্যবহারিক মূল্য বিবেচনায় সংরক্ষণ করা বা ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত করা হয়। এছাড়া ’বাংলাদেশ মহানগর ইমারত বিধিমালা-২০০৮’ অনুসারেও এ ভবন ভাঙ্গা আইনসিদ্ধ নয়। এই ভবনের সাংস্কৃতিক ঐতিহাসিক ও ব্যাবহারিক মূল্য রয়েছে। সমাবেশ থেকে বলা হয়, সিলেটের প্রথম সংবাদপত্র ‘শ্রীহট্ট প্রকাশ’-এর প্রেস ছিলো এই ভবনে। ‘শ্রীহট্ট প্রকাশ’ প্রকাশিত হয় ১৮৭৬ সালে । ১৯৩৬ সালে এখানেই ছোট পরিসরে হাসপাতাল চালু করা হয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় এ হাসপাতালের বর্ধিতাংশে বার্মা-ইংরেজ সৈনিকদের চিকিৎসা দানের লক্ষ্যে মিলিটারী হাসপাতাল চালু করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৪৮ সালে এ ভবনে মেডিকেল শিক্ষাদানের জন্য নির্মাণ করা হয় ‘লাইসেন্সড মেডিকেল ফেকাল্টি’ (এলএমএফ)। ১৯৬২ সালে এটিকে মেডিকেল কলেজে রূপান্তরিত করা হয় । ১৯৫৫ সালে এই ভবনের সম্মেলন কক্ষে ওস্তাদ আলাউদ্দীন খাঁ সঙ্গীত পরিবেশন করেন । এই ভবনের সাথে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি জড়িত । মুক্তিযুদ্ধে শহীদ প্রফেসর ডাঃ শামসুদ্দিন আহমদ এই মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের শল্য বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান (১৯৬৯-১৯৭১) হিসাবে দায়িত্বপালন কালেই পাক হানাদার বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে শহীদ হয়েছিলেন ।
অবিলম্বে আবুসিনা ছাত্রাবাস ভবন ভাঙ্গার কাজ বন্ধ করতে কর্মসূচি থেকে মাননীয় প্রধান গণতন্ত্রেও মানসকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করা হয়।
Sharing is caring!
………………………..
Design and developed by best-bd