সিলেট ১১ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২৬শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ৮ই জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি
প্রকাশিত: ৫:৫৮ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ২০, ২০১৮
জাহেদ আহমদ :: সিলেট-২ আসনে নির্বাচনি সব হিসেবনিকেশ ওলটপালট হয়ে গেছে। এই নির্বাচনি এলাকার ভোটাররা ২০১৪ সালের নির্বাচনের মতো এবারও নৌকা ও ধানের শিষ প্রতীক থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা লাইম লাইটে চলে এসেছেন। বিশেষ করে দুজন স্বতন্ত্র প্রার্থীকে নিয়ে বড় দুই দলের কর্মী-সমর্থকরা ভাবছেন।
সিলেটের ১৯ আসনের মধ্যে সিলেট-২ আসনে বিএনপির ছিল নিশ্চিত বিজয়ের আশা। কিন্তু সেই স্বপ্ন আশার ভরাডুবি ঘটল ভোট অনুষ্ঠানের আগেই। বিশ্বনাথ, ওসমানীনগর ও বালাগঞ্জের একাংশ নিয়ে গঠিত সিলেট-২ আসন। এখানে বিএনপি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী ছিলেন বিএনপির ‘নিখোঁজ’ নেতা এম ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহসিনা রুশদীর লুনা। প্রতীক পেয়ে নির্বাচনি প্রচার-প্রচারণায়ও নামেন তিনি। ‘নিখোঁজ’ নেতার স্ত্রী লুনাকে নির্বাচনি মাঠে পেয়ে আরো উজ্জীবিত হয়ে উঠে বিএনপি। লুনার বিজয়ধ্বনি উঠে আসে আলোচনায়। কিন্তু সেই বিজয়ের আগেই পরাজয় মেনে নিতে হলো লুনাকে। মহাজোটের প্রার্থী জাতীয় পার্টির ইয়াহ্ইয়া চৌধুরী এহিয়ার করা রিটের পরিপ্রেক্ষিতে লুনার প্রার্থিতা স্থগিত করেন আদালত। এই আদেশের বিপক্ষে লুনা হাইকোর্টে আপিল করলে সেটিও গত মঙ্গলবার খারিজ করে দেয় আপিল বিভাগ। হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন সাত বিচারপতির আপিল বেঞ্চ ‘নো অর্ডার’ আদেশ দেন। তাই বিএনপি প্রার্থী তাহসিনা রুশদীর লুনার মনোনয়ন বাতিল হওয়ায় এই আসনে বিএনপির ধানের শিষ প্রতীকে নির্বাচন করা হচ্ছে না। এ নিয়ে শুরু হয়েছে নানা জল্পনাকল্পনা। কোন পথে যাবে বিএনপি? নির্বাচনে যাবে নাকি নিজেদের পছন্দের প্রার্থী বাছাইয়ের মাধ্যমে জানাবে সমর্থন। এমন প্রশ্ন এখন মুখে মুখে।
এ আসনটিতে মহাজোট থেকে জাতীয় পার্টির ইয়াহইয়া চৌধুরী এহিয়াকে মনোনয়ন দিলেও প্রথম থেকে এহিয়ার প্রতি অনাস্থায় রয়েছে আওয়ামী লীগের বড় একটি অংশ। বিশ্বনাথ, ওসমানীনগর ও বালাগঞ্জ আওয়ামী লীগ মূলত দুটি গ্রæপে বিভক্ত। এর মধ্যে একটি অংশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন সাবেক সংসদ সদস্য শফিকুর রহমান চৌধুরী ও অপর অংশের নেতৃত্বে আছেন আওয়ামী লীগ নেতা আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। তাদের বলয়ের নেতৃবৃন্দ এখনো প্রকাশ্যে আসছেন না এহিয়ার পক্ষে।
১০ম সংসদ নির্বাচনে এহিয়া চৌধুরীর পক্ষে কাজ করেন শফিক চৌধুরী ও যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। বিএনপি র্নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করায় খালি মাঠে গোল দিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এহিয়া চৌধুরী। এবারও তাকে মহাজোট থেকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। এই নির্বাচনে অংশ নিতে নৌকার মনোনয়নের জন্য জোর তদবির চালিয়েছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাবেক সাংসদ শফিকুর রহমান চৌধুরী ও যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। কিন্তু জোটগত কারণে জাপাকে ছাড় দেয়া হয়। যা সহ্য করতে পারেননি শফিকুর চৌধুরী ও আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী বলয়ের নেতাকমীরা। তারা গত ২৭ নভেম্বর ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক অবরোধ করেন। নৌকা প্রতীকের দাবিতে উত্তাল ছিল রাজপথ। তারা বর্তমান সাংসদ এহিয়া চৌধুরীকে মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে মেনে নিতে নারাজ।
তাই সম্পূর্ণ বেকায়দায় রয়েছেন বর্তমান সংসদ সদস্য ইয়াহিয়া চৌধুরী। তবুও মাথা তুলে দাঁড়ানোর চেষ্ঠায় মহাজোটের পূর্ণ সমর্থন আদায়ে নেতাকর্মীদের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন তিনি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এহিয়াবিরোধী মিশন বাস্তবায়নে ইতোমধ্যে দু’একজন প্রার্থীর পক্ষে কাজ শুরু করেছে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন বলয়ের নেতাকর্মীরা। এ অবস্থায় বেশ ভালো অবস্থানে রয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী আওয়ামী লীগ নেতা মুহিবুর রহমান। তিনি বিশ্বনাথ উপজেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা। ১৯৯১ সালে সতন্ত্র হিসেবে, ২০০১ সালে জাতীয় পার্টি থেকে এবং ২০১৪ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেন মুহিবুর রহমান। এবারও তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হলে প্রথম অবস্থায় নির্বাচন কমিশনে তার মনোনয়ন বাতিল করা হয়। পরবর্তীকালে আপিলেও বাতিল হলে হাইকোর্টের মাধ্যমে প্রার্থিতা ফিরে পান তিনি। অবশেষে ‘ডাব’ প্রতীক নিয়ে চূড়ান্ত নির্বাচনি লড়াইয়ে রয়েছেন মুহিব। এই মুহিবুর রহমানের কাছেই উপজেলা নির্বাচনে বিশাল ব্যবধানে হেরেছিলেন এহিয়া। ২০১৪ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মহাজোট থেকে জাতীয় পার্টির এহিয়াকে এই আসন ছাড় দেয়া হয়। তখনও এহিয়ার বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে লড়েছেন তিনি। তবে এবার নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দুই গ্রæপের সাধারণ কর্মী-সমর্থকরা মুহিবের পক্ষে আছেন বলেও এলাকায় গুঞ্জন উঠেছে। বিশ্বনাথ, ওসমানীনগর ও বালাগঞ্জের তৃণমূল নেতাকর্মীরা মুহিবুর রহমানকে সমর্থন করছেন। এছাড়াও বিএনপির একটি অংশ মুহিবুর রহমানকে সমর্থন করছে বলে জানা গেছে।
গতকাল বুধবার বিকেলে বিশ্বনাথে নতুনবাজারস্থ নির্বাচনি কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময় করেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী মুহিবুর রহমান।
মতবিনিময়কালে তিনি বলেছেন, নৌকার আসনটি পুনরুদ্ধারের জন্য স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। এবারের নির্বাচনে নৌকার আসন উদ্ধার করতে তৃণমূল আওয়ামী লীগ থেকে ভোট পাবেন বলে আশা করেন।
এ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী ড. এনামুল হক সরদারেরও প্রভাব রয়েছে। সিংহ প্রতীকে এই প্রার্থীও রয়েছেন শক্ত অবস্থানে। নিজের অবস্থান জানান দেন গত জেলা পরিষদ নির্বাচনে। এই নির্বাচনে জয়ী না হলেও তিনি ছিলেন দিতীয় অবস্থানে। এই নির্বাচনে তার বেশ কিছু নিজস্ব বলয়ের ভোট রয়েছে।
এ দিকে বিএনপি প্রার্থীশূন্য হওয়ায় কপাল খোলার অপেক্ষায় রয়েছেন খেলাফত মজলিসের প্রার্থী দেয়ালঘড়ি প্রতীকের মুনতাছির আলীর। কিন্তু তার ভাগ্য খুলবে কিনা এখনই বলা যাচ্ছে না। কেননা তার বিরুদ্ধেও অভিযোগ উঠছে বিএনপি থেকে। বিএনপির একটি সূত্র জানায়, মুনতাছির বিএনপি জোট থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। মনোনয়নবঞ্চিত হয়ে তিনি যখন স্বতন্ত্র প্রার্থী হন তখন বিএনপির প্রার্থী ও নেতৃবৃন্দের পথের কাঁটায় পরিণত হন। বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী বলেন, ইলিয়াস আলী নিখোঁজ আন্দোলনে খেলাফত মজলিস বা মুনতাছির আলীর কোনো অবদান ছিল না। ইলিয়াস পতœী যখন প্রার্থী হলেন তখনও তিনি তাঁর প্রতি কোনো ধরনের সম্মান প্রদর্শন করে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেননি। তাই তার পক্ষে নির্বাচনে কাজ করার প্রশ্নই উঠে না বলে জানান তারা। নিখোঁজ বিএনপি নেতা এম. ইলিয়াস আলীর পতœী তাহসিনা রুশদীর লুনাকে সরানোর জন্য আড়ালে থেকে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন মুনতাসীর আলী। লুনার প্রার্থিতা বাতিলের পর থেকে এমন শোরগুলও শোনা যাচ্ছে।
সিলেট-২ আসনে আওয়ামী জোট থেকে মনোনয়ন নিশ্চিত হওয়ার পর এহিয়াকে আড়ালে সার্বিকভাবে গাইড লাইন দিতে থাকেন মুনতাসীর আলী। কেননা লুনার প্রার্থিতা বাতিল হলে ২৩ দলীয়ভাবে একমাত্র মুনতাসীর আলী থাকবেন প্রার্থী। শেষে কেন্দ্র তাকে সমর্থন দিলে নির্বিঘেœ বিজয়ী হবেন। এমনটাই ছিল তাঁর আশা।
সিলেটের নির্বাচনের ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো সিলেট-২ আসনে ধানের শিষ ছাড়া নির্বাচন হলেও এবার এ আসনে প্রার্থী রয়েছেন আরো ৯ জন। তাদের মধ্যে রয়েছেন মহাজোটের প্রার্থী জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব ও বর্তমান সাংসদ ইয়াহ্ইয়া চৌধুরী এহিয়া, ২০ দলীয় জোটের শরীক খেলাফত মজলিসের মো. মুনতাছির আলী, গণফোরমের মোকাব্বির খান, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মো. আমীর উদ্দিন, ন্যাশনাল পিপলস পার্টির মো. মনোয়ার হোসাইন, বিএনএফের মো. মোশাহিদ খান এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী মুহিবুর রহমান, অধ্যক্ষ এনামুল হক সরদার ও আব্দুর রব মল্লিক।
Sharing is caring!
………………………..
Design and developed by best-bd