সিলেট ১৯শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৬ই ফাল্গুন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ১৯শে শাবান, ১৪৪৬ হিজরি
প্রকাশিত: ১০:১২ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ৩, ২০১৮
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা , প্রধান সম্পাদক, জিটিভি :: গণতন্ত্রের ভিত যে এখনও দেশের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কাঠামোতে খুব গভীরতা পেয়েছে— এমনটা বলা যাবে না। গণতন্ত্র আলাপ-আলোচনার, সংলাপের পরিসর তৈরি করে, এসবই সত্য। তবে গণতন্ত্রতো আইনের অনুশাসনে অতীতের অন্যায় কৃতকর্মের শাস্তির ব্যবস্থা করতেও বলে। তাহলে প্রশ্ন জাগে আগে কোনটি হবে?
‘ব্যক্তি বনাম ব্যক্তি, ব্যক্তি বনাম গোষ্ঠী, গোষ্ঠী বনাম গোষ্ঠী, সম্প্রদায় বনাম সম্প্রদায় – এমন নানা ভাবে পরিকল্পিত উপায়ে হিংসার বহিঃপ্রকাশ ঘটানো হয়েছে বারবার। রাতারাতি এগুলো দূর হবে না। দলমত নির্বিশেষে গণতন্ত্রের আওয়াজ তোলার আগে সাম্প্রদায়িক হামলা, রাজনৈতিক দল নিশ্চিহ্ন করার হামলা নিয়ে সবাই সরব হলে হিংসার আধিপত্য বিস্তারের সংস্কৃতিকে বিদায় জানানো সম্ভব হবে, গণতন্ত্রও আসবে।’
ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে বিএনপি নেতারা গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনকে দিয়ে অনেক দাবির সাথে হারিয়ে যাওয়া, বা তাদের ভাষায় ‘গুম’ হয়ে যাওয়া অনেক মানুষের একটি তালিকা নাকি দিয়েছেন। এটি সুশাসনের একটি বড় অন্তরায় অবশ্যই। কিন্তু জানা গেল না, আওয়ামী লীগ নেতারা ২০০১-এর নির্বাচনের পর সারাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের উপর যে আইয়েমে জাহিলিয়াতের অত্যাচার নেমে এসেছিল তার বর্ণনা দিয়েছেন কিনা।
সেদিন দেশের সব জনপদে লুট, আগুন আর ধর্ষণের যে উৎসব করেছিল একাত্তরের পরাজিত শক্তি সেই দুঃস্বপ্নের রাত হয়তো সবাই ভুল গেছে। সেদিন ৭ বছরের শিশু থেকে ৬৫ বছরের বৃদ্ধা– হিন্দু পরিবারের কত নারী ধর্ষিতা হয়েছিলেন, কত ঘর পুড়েছিল, কত লুট হয়েছিল, কত কত মামলা হয়েছিল ওবায়দুল কাদেররা সেই তালিকা দিলেন কিনা তাও জানা গেল না।
শিষ্টতার পাঠ বলবে, একটি রাজনৈতিক দল যদি অপর দল সম্বন্ধে অভিযোগ আনে, তাহলে নিজেদের দ্বারা সংগঠিত কর্মকাণ্ড নিয়েও সততার দৃষ্টান্ত দেখাবে। সেই গ্রেনেড হামলার স্বর্ণযুগে সে সময়ের বিরোধী দল আওয়ামী লীগ একে একে হারিয়েছে তার সব বড় রাজনীতিকদের– শাহ এ এম কিবরিয়া, মঞ্জুরুল ইমাম, আহসান উল্লাহ মাস্টার, মমতাজ উদ্দিনকে। তারপর এক মোক্ষম সময়ে আঘাত এসেছিল শেখ হাসিনার নিজের উপরই।
২০০৪ সালের একুশে আগস্ট পরিকল্পিত আয়োজনে তখনকার বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা ও তার দলকে নেতৃত্বশূন্য করতে যুদ্ধের ময়দানের গ্রেনেড নিয়ে এসে হামলা হয়েছিল। দৈবক্রমে বেঁচেছেন তিনি, কিন্তু হারিয়েছেন আইভি রহমানের মতো কেন্দ্রীয় নেতাসহ ২৪ জন কর্মীকে। কিন্তু সবচেয়ে বেশি তিনি যা হারিয়েছেন তাহলো বিশ্বাস। তিনি আর বিশ্বাস রাখতে পারছেন না যে, বিএনপি’র সাথে আর কোন স্বাভাবিক আলোচনা করা যায়।
ড. কামাল, আ স ম রব বা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীররা যখন বলছেন তারা সন্তুষ্ট নন, তখন আরেকবার তাদের ভাবা দরকার কোন রাজনৈতিক সংস্কৃতি জন্ম হয়েছিল ২০০১- এর নির্বাচনের পর। সেই প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিলে তারা দেখবেন তাদের অর্জন অনেক বেশি। যাকে হত্যা করতে চেয়েছিলেন, যার দলকে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিলেন, যার দলের হাজার কর্মী খুন হয়েছিল, ১৯৭১-এর কায়দায় যারা ধর্ষণ সংস্কৃতি চালু করেছিল, তাদের সাথে এই বৈঠক মানেই একটি কার্যকরী সম্পর্কের সূচনা।
রাজনৈতিক বিতর্ক তীব্র হচ্ছে নির্বাচনকে ঘিরে। শাসক দলের অনেক আচরণ গণতন্ত্রের মান সম্পন্ন নয়, একথাও ঠিক। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্তে পৌঁছাবার সুযোগ আসুক, এটা সবাই চায়। কিন্তু গণতন্ত্র মানে শুধুই একটি নির্বাচন, একথা ভাবা আর সম্ভব হচ্ছে না হিংসাদীর্ণ সেই সময়টার কথা ভাবলে।
আধিপত্য কায়েমের এই ব্যবস্থার মধ্যেই নিহিত আছে হিংসা, যাকে বলা যায় ‘সিস্টেমেটিক ভায়োলেন্স’। এই সহিংতা আবার দেশ প্রত্যক্ষ করেছে ২০১৩ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত। পেট্রল বোমা নামের এক বিভৎসতায় দেশ জ্বলেছে, দেশের মানুষ জ্বলেছে মাসের পর মাস ধরে। আমরা বলি, রাজনৈতিক সংস্কৃতি হতে হবে বহুত্ববাদী। কথা ঠিক। কিন্তু ১৯৭৫ থেকে যেভাবে পরমত সহিষ্ণুতা কমছে, তাতে হিংসা ছাড়া আর কিইবা আসলে এদেশের রাজনীতিতে উৎপাদিত হয়েছে?
জামায়াত-বিএনপির জোট জমানায় যে দলতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল জেলায় জেলায়, সেই সঙ্কীর্ণ দলীয় আধিপত্য আসলে সমাজকে অবৈধ ভাবে নিয়ন্ত্রণের জাল বিস্তারের প্রচেষ্টা যা থেকে বের হতে পারছেনা কোন দলই। ১৯৭৫-থেকে ধর্মীয় বিচারে মানুষকে নির্যাতন করার পাশাপাশি শুরু হয় রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িকতার সংস্কৃতি, যে সংস্কৃতি উদারনৈতিক সেক্যুলার পথকেই কেবল সংকুচিত করেছে।
এর মধ্যে সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বিকল্পধারার সাথে সংলাপও হয়েছে। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনীতির ইতিহাসে এর আগে অন্তত তিনবার দুই প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের মধ্যে আলোচনা কিংবা সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে, যার মধ্যে দু’বার হয়েছে বিদেশিদের মধ্যস্থতায়।
সেই সংলাপগুলো সফল না হলেও সব পক্ষ এবারের সংলাপের ধারা অব্যাহত রাখলে সফলতা আসতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ১৯৯৪, ২০০৬ এবং ২০১৩ সালে আওয়ামী লীগ-বিএনপির মধ্যে সংলাপ হয়। সর্বশেষ ২০১৩ সালে জাতিসংঘের রাজনীতি বিষয়ক সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর মধ্যস্থতায় হয় আলোচনা। কিন্তু সবশেষে দেখা গেছে উভয়পক্ষ তাদের দাবিতে অনড় থাকায় কোন সমাধান ছাড়াই শেষ হয়েছে সংলাপ।
সংলাপের মাধ্যমে একটি ‘রাস্তা’ খুলেছে। সফলতাও আছে। সভা সমাবেশের নিশ্চয়তা পাওয়া গেছে। মির্জা ফখরুল সংলাপের পরপর সংবাদ সম্মেলনে যা বলেছে তা বেশ প্রণিধানযোগ্য। বলেছেন, প্রথম মিটিংয়েই সবকিছু মিটে যাবে এটা আশা করা যায় না। এটাই আসল কথা। সংবিধানের ভেতর থেকেই সমাধানগুলো খুঁজে বের করতে হবে, এমন একটি পথই সংলাপ সফল করার বড় উপায়।
ব্যক্তি বনাম ব্যক্তি, ব্যক্তি বনাম গোষ্ঠী, গোষ্ঠী বনাম গোষ্ঠী, সম্প্রদায় বনাম সম্প্রদায় – এমন নানা ভাবে পরিকল্পিত উপায়ে হিংসার বহিঃপ্রকাশ ঘটানো হয়েছে বারবার। রাতারাতি এগুলো দূর হবে না। দলমত নির্বিশেষে গণতন্ত্রের আওয়াজ তোলার আগে সাম্প্রদায়িক হামলা, রাজনৈতিক দল নিশ্চিহ্ন করার হামলা নিয়ে সবাই সরব হলে হিংসার আধিপত্য বিস্তারের সংস্কৃতিকে বিদায় জানানো সম্ভব হবে, গণতন্ত্রও আসবে।
লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি।
Sharing is caring!
………………………..
Design and developed by best-bd