উগ্রবাদকে তোষণ নয়

প্রকাশিত: ৫:০৩ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ২০, ২০১৮

উগ্রবাদকে তোষণ নয়

Manual2 Ad Code

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা , প্রধান সম্পাদক, জিটিভি :: বাংলাদেশে আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যখন ভোট জোট আর নানা মেরুকরণ চলছে নরসিংদীতে দুটি জঙ্গিবিরোধী সফল অভিযান শেষ করেছে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট। একটিতে এক নারী ও এক পুরুষ জঙ্গি মারা গেছে, আরেকটিতে রক্তপাত ছাড়াই দুই নারী জঙ্গি আত্মসমর্পণ করেছে।

নির্বাচনের আগে আগে জঙ্গিদের এমন নড়াচড়া আমাদের আতঙ্কিত করে। সন্দেহ নেই আমাদের পুলিশ, র‌্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অত্যন্ত দক্ষতা আর সাহসের সাথে জঙ্গিদের খতম করছে। কিন্তু নির্বাচনের সময় জঙ্গিদের আবার সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা বলে দেয় বাংলাদেশে এই সমস্যাটি আসলে পুরো মাত্রায় রাজনৈতিক।

 বাংলাদেশে উগ্রবাদী বিপদের মূল উৎস একাত্তরের পরাজিত ঘাতক শক্তি। এদের সঙ্গে চূড়ান্ত বোঝাপড়ায় নেমেছে শেখ হাসিনার সরকার। তাকে অনেক কৌশল করে এগুতে হচ্ছে। কিন্তু দেশের মনুষ যেন এটা মনে না করে যে, এই কৌশল অতি নমনীয়। 

Manual7 Ad Code

মুক্তচিন্তার মানুষ, ধর্মগুরু, সম-অধিকার আন্দোলনকর্মী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যদের উপর একের পর এক আঘাতের পর ২০১৬ সালের পহেলা জুলাই ক্যাফে হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার ঘটনার পর পুলিশের সাফল্য দেশবাসীকে অনেকদিন ধরে স্বস্তিতে রেখেছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে তারা বারবারই ঘুরে দাঁড়াবার শক্তি খোঁজে।

জেহাদি নাশকতা এক নিশ্বাসে সন্ত্রাস বলে বিবেচিত হয়। কিন্তু আসলে তার সাথে রাজনীতির সংযোগ আছে। একটা সময আমরা দেখেছি, বিশেষ করে জেএমবি’র জেগে উঠার সময় আমাদের শাসনযন্ত্র, রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ ও নিরাপত্তা সংস্থাগুলো সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে কঠোর দমননীতি গ্রহণে অপারগতা দেখিয়েছে।

Manual3 Ad Code

এই ধারাবাহিক অপারগতাই জেহাদিদের নির্ভয় করেছে যত্রতত্র ঘাঁটি গাড়তে, যেখানে সেখানে জঙ্গি হামলা চালাতে ও যে কাউকে হত্যা করতে। দেশের গোটা শাসনব্যবস্থাই যে এই ধরনের সন্ত্রাস ও জঙ্গি ভাবাদর্শে প্রভাবিত হয়েছিল তার প্রমাণ ছিল ২০০৪ সালের ২১শে আগস্ট গ্রেনেড হামলা। শেখ হাসিনাসহ পুরো আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকে বিনাশ করার জন্য যে নারকীয় হামলা হয়েছিল সেই মামলার রায় হয়েছে কয়েকদিন আগে।

সন্ত্রাস আর জঙ্গিদের বিরুদ্ধে কড়া অবস্থান চায় মানুষ। কোনও ছাড় চায় না। কিন্তু বিষয়টি শুধুমাত্র পুলিশী বা প্রশাসনিক পদক্ষেপে নয়, তার চেয়েও বেশি কিছু দিয়ে এগিয়েছে বাংলাদেশ। সাধারণ মানুষ তার ঐক্য গড়েছে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে।

Manual2 Ad Code

সমস্যাটা শুধু আইনশৃংখলাজনিত নয়, বরং অনেকাংশেই তা রাজনৈতিক। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো কিছু না কিছু উগ্রবাদী দলের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলে। এটা কোন কোন ক্ষেত্রে কৌশল হিসেবেই দেখা হয়। তবে উগ্রবাদের প্রতি দেশের রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তির সমর্থন বা নমনীয়তা থাকলে তা দমানো সহজ কাজ নয়।

একের পর পর লেখক ব্লগার খুন, পুরোহিত খুন, খ্রিস্টান যাজক খুনের চেষ্টা, বিদেশি খুন, শিয়া ও আহমদিয়াদের উপর আক্রমণ যখন হচ্ছিল তখন মানুষ একটা সংশয়ে পড়েছিল, এটাই বুঝি বাংলাদেশের নিয়তি। হলি আর্টিজানের হামলা মানুষকে যেমন সন্ত্রাস আর জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করেছে, তেমনি সরকারকেও অনেক প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করেছে।

এই রাজনীতি দেশীয় রাজনীতি যেমন, তেমনি আন্তর্জাতিকও। দেশীয় রাজনীতি এ কারণে যে, এই টার্গেট কিংলিং শুরু হয় যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে গড়ে উঠা গণজাগরণ মঞ্চের সময়। আস্তিক-নাস্তিক বিতর্ককে সামনে আনা হয়েছে জঙ্গি মতাদর্শের প্রতি রাজনৈতিক সমর্থন দিতেই।

কঠিন রাজনৈতিক অঙ্গীকার ছাড়া জঙ্গিবাদ মোকাবেলা কঠিন। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার সম্ভব হয়েছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তি কার্যকর করা গেছে, এর পেছনে সরকার, বিশেষ করে তার শীর্ষ পর্যায়ে দৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকার কাজ করেছে বলেই।

জঙ্গিবাদ আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা প্রশ্নেও বড় বিষয়। এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিতর্ক কাম্য নয়। যেকোনো দেশের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য এটা বড় সংকট। বাংলাদেশে জঙ্গিরা বিচ্ছিন্নভাবে কিছু পকেটে তৎপরতা চালালেও বৃহত্তর সমাজে শিকড় গাড়তে পারেনি। এর অন্যতম কারণ, এখানকার মানুষের সহিষ্ণু মনোভাব ও নারীর ক্ষমতায়ন।

আয়তনে বাংলাদেশ ছোট হলেও এর রয়েছে বিশাল জনগোষ্ঠী। এত বড় সমাজে কেবল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে জঙ্গি মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। এর জন্য রাজনৈতিক, শিক্ষাগত, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। এমন বাস্তবতায় জঙ্গিবাদ নিয়ে সরকার তথা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার স্পষ্ট অবস্থান খুব জরুরি ছিল যা আমরা এই সরকারের সময়ে দেখতে পাচ্ছি।

সামনে নির্বাচন। নানা ধরনের রাজনৈতিক সমীকরণ হব। সবাই ক্ষমতায় যেতে চাইবে। কিন্তু সব দলের, বিশেষ করে যারা ধর্ম ব্যবসার রাজনীতি করেনা, তাদের ভাবনায় পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। সরকারের সাথে যে বিরোধই থাকুক না কেন, কোন পক্ষ যেন জঙ্গি ও সন্ত্রাসের প্রতি হাত না বাড়ায়। রাজনৈতিক স্তরে এই বিরোধ এক অন্য মাত্রা পরিগ্রহ করে। সেই মাত্রাটি স্পষ্ট হয় শাসক দল ও বিরোধী পক্ষের পারস্পরিক দোষারোপে। এ ধরনের সংঘাতময় রাজনৈতিক পরিস্থিতি জঙ্গিদেরই উৎসাহিত করে, সুবিধাও করে দেয়।

জঙ্গিদের পুলিশী চাপে রাখতেই হবে, তার কোন বিকল্প নেই। উগ্রবাদকে তোষণ করার নীতি বা কৌশল কোন মঙ্গল বয়ে আনবে না। একটি গোষ্ঠী ধর্মের সঙ্গে আমাদের সংস্কৃতির বিরোধ তৈরি করতে চায়। আমাদের রাজনীতি যেন শুধু প্রতিপক্ষের সাথে বিরোধিতার কারণে সেই ফাঁদে পা না দেয়।

বাংলাদেশে উগ্রবাদী বিপদের মূল উৎস একাত্তরের পরাজিত ঘাতক শক্তি। এদের সঙ্গে চূড়ান্ত বোঝাপড়ায় নেমেছে শেখ হাসিনার সরকার। তাকে অনেক কৌশল করে এগুতে হচ্ছে। কিন্তু দেশের মনুষ যেন এটা মনে না করে যে, এই কৌশল অতি নমনীয়।

লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি।

Manual8 Ad Code

Sharing is caring!

বিজ্ঞাপন

আর্কাইভ

October 2018
S S M T W T F
 12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
2728293031  

সর্বশেষ খবর

………………………..