সিলেটে কণ্ঠশিল্পী সোনিয়ার মৃত্যু নিয়ে নানা প্রশ্ন : গোপনে দাফন

প্রকাশিত: ১১:০৪ অপরাহ্ণ, আগস্ট ৮, ২০১৮

সিলেটে কণ্ঠশিল্পী সোনিয়ার মৃত্যু নিয়ে নানা প্রশ্ন : গোপনে দাফন

আমির হোসেন সাগর :: ‘তুমি বাসায় আসবে না? আমি বলি না, তুমি আগে ঠিক হও, ভালোভাবে চলাফেরা কর, এই কথা বলে দরজা বন্ধ করে দেই। এর দু এক মিনিট যেতে না যেতেই চিৎকার শুনি, দরজা খুলে দেখি সোনিয়ার শরীরে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে, তবে তাকে বাঁচাতে পারিনি’ এই কথাগুলো সদ্য মৃত্যুবরণকারী প্রতিভাবান কণ্ঠশিল্পী সোনিয়া সুলতানার স্বামী সাহেদুল ইসলাম শিপলুর। ময়নাতদন্ত ছাড়াই গত ৪ আগস্ট গোপনে দাফন করা হয়েছে সোনিয়া সুলতানাকে। এটি স্বাভাবিক মৃত্যু না হত্যাকান্ড এ বিষয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে অনুসন্ধানে।

সোনিয়া সুলতানার বয়স ছিলো মাত্র ২০ বছর। এই অল্প সময়ে সিলেটের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ব্যাপক পরিচিতি পান তিনি। মূল দখল ছিল বাউল গানে। প্রতিভাবান এই শিল্পীর মৃত্যুর প্রকৃত কারণ যেন সবার বলতে বারণ। বাবা-মা-শ্বশুর-শাশুড়ি ,স্বামী কিংবা সহপাঠী কেউ মুখ খুলেননি। সোনিয়া সুলতানার ছবি দিয়ে কেউ একজন ‘নীরবে চলে গেলেন সোনিয়া সুলতানা’ পোস্টটি দিলে নজরে আসে প্রতিবেদকদের। এর সূত্র ধরে এগুতে গিয়ে বেরিয়ে আসে নানা অজানা কাহিনী।

সেদিনকার সোনিয়ার মৃত্যুর ঘটনার বর্ণনা শোনে গা শিউরে উঠবে যে কারো। সোনিয়া মারা যান মূলত পেট্রোলের আগুনে পুড়ে। ঘটনাটি ঘটে গত ২৬ জুলাই সিলেট নগরীর ২৩ নং ওয়ার্ডের ছড়ারপারে সুগন্ধা ১২ নং বাসায়। এই বাসায় বসবাস করেন সোনিয়ার স্বামীর সাহেদুল ইসলাম শিপলু। তার দাবি ‘সোনিয়া নিজইে শরীরে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেন। এতে তার মৃত্যু হয়’। শিপুলর বাবা শামসুল আলম । মহানগর বিএনপির নেতা তিনি। ডিসকো নামেই বেশি পরিচিত।

সোনিয়াদের বাড়ি সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার ভাটিপাড়া আলীনগর গ্রামে। বাবা মোঃ মজিবুর রহমান পেশায় সিএনজি অটোরিক্সা চালক। তারা দীর্ঘদিন থেকে বসবাস করছেন নগরীর সুবিদবাজার এলাকায়। সোনিয়া ও তার ভাই-বোনদের জন্ম সিলেটেই। স্কুলে ভালো গান করতেন সোনিয়া, সেই থেকে জড়িয়ে পড়েন বাউল গানের সাথে। ছোট বোন প্রিয়াও ভালো গান করে। দুবোনই নানা স্টেজ শোতে অংশ নিতেন।

সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভর্তি রেজিস্ট্রার অনুসন্ধানে পাওয়া যায়, সোনিয়া সুলতানা গত ২৬ জুলাই বেলা ১১টা ৫৫ মিনিটে আগুনে দগ্ধ রোগী হিসেবে হাসপাতালে ভর্তি হন। তিনি হাসপাতালের ৪ তলা, ৬ নং ওয়ার্ডের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন ছিলেন। ঐদিন রাতেই সোনিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এরই মধ্যে ছেলেকে বাঁচাতে তৎপর হয়ে উঠে শিপলুর পরিবার।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সোনিয়ার এক বান্ধবী জানান, সিলেটে সোনিয়াকে রাখলে বিষয়টি দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে, এর জন্য তাকে দ্রুত ঢাকায় পাঠানো হয়। আবার ঢাকা মেডিকেলে মারা গেলে ঝামেলার সৃষ্টি হবে, এরজন্য দ্রুত জীবিত অবস্থায় সোনিয়াকে ছাড়পত্র নিয়ে সিলেটে নিয়ে আসা হচ্ছিলো। সিলেটে নিয়ে আসার পথেই সোনিয়ার মৃত্যু হয়। এর পিছনে রহস্য কী। তিনি দাবি করেন, সোনিয়ার পরিবারকে ফাঁদে ফেলে দুটি পরিবার মিলে হত্যাকান্ডটি চাপা দেয়ার চেষ্টা করছেন। সোনিয়ার বাবা মজিবুব রহমানও সিলেটে ফেরার পথে এম্বুলেন্সেই সোনিয়ার মৃত্যু হয় বলে স্বীকার করেন।

দুই পরিবারের সম্মতি ছাড়া চলতি বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি সিলেটের কোর্টে বিয়ে করেছিলেন সাহেদুল ইসলাম শিপলু ও সোনিয়া সুলতানা। এর আগে ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে ফেইসবুকের সম্পর্কের সূত্র ধরে পরিচয় হয় দুজনের। সাহেদুল ইসলাম শিপলুর দাবি, সিলেট কোর্টের একজন আইনজীবীর মাধ্যমে তাদের বিয়ে সম্পন্ন হয়। এরপর থেকে পরিবারের অজান্তে সুবিদবাজার এক্সেল টাওয়ার সংলগ্ন টিনসেড বাসায় গোপনে সংসার করে আসছিলেন তিনি। একসময় পরিবারে জানাজানি হলে তোপের মুখে পড়েন শিপলু। তবুও সংসার করছিলেন তিনি। শিপলু জানান, সোনিয়া তাকে এর আগে একটি বিয়ে হয়েছিলো এবং একটি মেয়ে রয়েছে বলে জানিয়েছিলেন। তবে বিয়ের পর শোনা যায় তার বহু বিবাহ রয়েছে। চলাফেরায়ও বেশ উচ্ছৃঙ্খল, এরপর থেকে গান না গাইতে চাপ সৃষ্টি করেন তিনি। শিপলুর দাবি অনেক ঘটনা ঘটেছে সোনিয়ার পরিবারকে জানালেও কেউ গুরুত্ব দেয়নি। সর্বশেষ তিনি গত ২০ জুলাই সুবিদবাজারের বাসা ছেড়ে শিপলু ছড়ারপারের বাসায় বাবা-মার কাছে চলে আসেন।

সাহেদুল ইসলাম শিপলু বলেন, ‘২৬ জুলাই সকাল সাড়ে ১০টার দিকে হঠাৎ দেখি সোনিয়া ছড়ারপারের বাসায় এসে হাজির। দরজা খুললে তাকে দেখতে পেয়ে আমি বলি তুমি এখানে কেন এসেছো? সে বলে তুমি বাসায় আসবে না? আমি জবাব দেই তুমি বাসায় যাও, নিজে ঠিক হও তারপর আসবো। এই কথা বলে দরজা বন্ধ করে দেই। এর দু এক মিনিট পর দরজার বাইরে হঠাৎ চিৎকার শুনতে পেয়ে দরজা খুলে দেখি তিন তলা বাসার ২য় তলার সিঁড়িতে সোনিয়ার শরীরে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। সাথে সাথে নেভাতে গিয়ে নিজের হাত দগ্ধ হয় বলে দেখান শিপলু। এরপর দ্রুত তার বাবা-মাকে নিয়ে সিলেট ওসমানী হাসপাতালে নিয়ে যান সোনিয়াকে। ঘটনার সময় সোনিয়ার বোন প্রিয়াও সাথে ছিলো।’

অপরদিকে, নিজ বাসায় এতোবড় একটি ঘটনা ঘটলেও সবকিছু প্রতিবেশীর কাছে গোপন ছিলো। হাসপাতালের রেজিস্ট্রারে সোনিয়ার বাসা সুবিদবাজার উল্লেখ করে জুড়ে দেয়া হয় সোনিয়ার বাবার মোবাইল নম্বর।

শিপলুর বাবা শামসুল আলম ডিসকোর দাবি, সোনিয়া এর আগে কখনো তাদের বাসায় যায়নি। এই প্রথম এসেই বাসার দু’তলার সিঁড়িতে ঘটনা ঘটায়। সোনিয়াদের পরিবারের পক্ষ থেকে কেউ কখনো যোগাযোগও করেনি বলে জানান তিনি। তার দাবি ছেলে শিপলুকে ফাঁদে ফেলা হয়েছিলো। ডিসকো তার স্ত্রীর বরাত দিয়ে আরো জানান, সোনিয়া যখন বাসায় প্রবেশ করে তখন তার শরীর থেকে পেট্রোলের গন্ধ বের হচ্ছিলো। তবে নিজ বাসায় এতবড় ঘটনা ঘটলেও পুলিশকে কেন অবহিত করেননি বললে সাধারণ ডায়েরি করেছেন বলে জানান। তবে কতোয়ালী থানার ওসি মোশররফ জানান, থানায় কোনো সাধারণ ডায়েরি করা হয়নি।

এদিকে, সোনিয়ার পরিবারের ভূমিকা আরো রহস্যজনক। সুবিদবাজারের নিজের বাসায় গিয়ে পাওয়া যায়নি পরিবারের কাউকে। গোপনে ফাজিলচিস্ত এলাকায় এক আত্মীয়ের বাসায় গিয়ে কথা হয় সোনিয়ার বাবা মজিবুর রহমানের সাথে। মজিবুর রহমান জানান, এটি ছিলো তার মেয়ের তৃতীয় বিয়ে। প্রথম বিয়ে হয় পাঠানটুলা এলাকার মোহনা ১৬ নং বাসার মদই মিয়ার পুত্র কালামের সাথে। এই সংসারের ৪ বছর বয়সি একটা মেয়ে রয়েছে। নাম তার কণা। সে হাজী আব্দুল গফুর বিদ্যালয়ের শিশু শ্রেণিতে পড়ছে। ২য় বিয়ে হয় ছাতকের জাউয়াবাজার এলাকার একটি ছেলের সাথে। তৃতীয় বিয়ে হয় শিপলুর সাথে। সর্বশেষ শিপলুর সাথেই সংসার করছিলো। সকল বিয়েই সোনিয়া সব নিজের ইচ্ছায় করে বলে জানান মজিবুর।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সোনিয়ার অপর এক বান্ধবী জানান, সোনিয়ার মূলতঃ ৪টি বিয়ে হয়েছিলো। সোনিয়ার ঐ বান্ধবীর দাবি সর্বশেষে শিপলুকে নিয়েই বাঁচতে চেয়েছিলো সোনিয়া। স্টেজ শো করে যে টাকা পেতো তা দিয়ে নিজের এবং বাবার সংসার চালাতো। শিপলু বাবার পরিবার থেকে চলে আসায় কোনো কাজে ছিলো না, সোনিয়াই টাকা পয়সা ম্যানেজ করে সংসার চালাতো।

অন্যদিকে, কী কারণে সোনিয়া নিজের শরীরে পেট্রোল ঢেলে নিজেকে দগ্ধ করে মৃত্যুররণ করতে পারে এমন প্রশ্ন ঘোরপাক খাচ্ছে সিলেটের সংস্কৃতিকর্মীদের মনে। দুই পরিবারের নীরবতা নিয়েও নানা প্রশ্ন উঠেছে। তাকে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে না নিজেই আত্মহত্যা করেছে এর তদন্ত দাবি করেছেন কাকলী এ্যানি নামক সিলেটের এক সংগীত শিল্পী।

ঘটনার দিন অন্যতম প্রত্যক্ষদর্শী সোনিয়ার বোন প্রিয়া জানায়, সে তখন নিচের তলায় বাসার বাইরে ছিলো। তাদের সাথে হাসপাতালে গিয়েছে। কিভাবে ঘটনা ঘটেছে সে দেখেনি।

সিলেটের সিনিয়র আইনজীবী সাবেক পিপি এডভোকেট এমাদুল্লাহ শহীদুল ইসলাম শাহীন বলেন, প্রথমত মেয়ের পিতা বা পরিবারের কেউ বাদী হয়ে মামলা করবেন। না হলে তৃতীয় পক্ষের কেউ বাদী হতে পারেন। এছাড়া, ফৌজদারী কার্যবিধি অনুযায়ী কোথাও আমলযোগ্য অপরাধ সংঘটিত হলে, শোনা মাত্রই পুলিশ এটি আমলে নিয়ে তদন্তের ব্যবস্থা করবে। আইনে পুলিশের দায়িত্ব এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। এটি পুলিশেরই দায়িত্ব।

কতোয়ালী থানার ওসি মোশররফ হোসেন জানান, আগুনে অগ্নিদগ্ধ হওয়ার ঘটনায় কতোয়ালী থানায় কোনো সাধারণ ডায়েরি হয়নি। কোনো অভিযোগও পাওয়া যায়নি।

সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার পরিতোষ ঘোষ জানান, বিষয়টি তাৎক্ষণিক পুলিশকে জানানো উচিত ছিলো। এমন কি লাশ দাফনের আগেও জানালে আমরা যথাযথ পদক্ষেপ নিতে পারতাম। এখন প্রথমে লাশের ময়না তদন্ত করতে হবে এবং আদালতের শরণাপন্ন হতে হবে। তিনি, সোনিয়ার পিতার নীরবতাকে রহস্যজনক মনে করে বলেন, সোনিয়ার আত্মীয় স্বজন বা বন্ধু বান্ধবদের যে কেউ আদালতে আবেদন করতে পারেন। পুলিশ যথাযথ পদক্ষেপ নেবে।

Sharing is caring!

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

বিজ্ঞাপন

আর্কাইভ

সর্বশেষ খবর

………………………..