‘ওই দেশের পুরুষরা যে কতটা খারাপ সেখানে না গেলে কেউ বুঝবে না’

প্রকাশিত: ২:১১ অপরাহ্ণ, মে ৩০, ২০১৮

‘ওই দেশের পুরুষরা যে কতটা খারাপ সেখানে না গেলে কেউ বুঝবে না’

Manual8 Ad Code

ক্রাইম সিলেট ডেস্ক : ‘পরিবারের কষ্ট দূর করতে গিয়ে নিজেই মৃত্যুর কাছে চলে গিয়েছিলাম। তিনজন পুরুষ মিলে অমানুষিক নির্যাতন চালায় আমার ওপর। কোনো খাবার এবং কাপড়-চোপড় দিত না। নির্যাতন সইতে না পেরে দেশে ফিরে এসেছি’—গৃহকর্মীর কাজ নিয়ে তিন মাস আগে সৌদি আরব যাওয়ার পর গত ২১ মে দেশে ফিরে আসা নোয়াখালীর রিজিয়া বেগম (ছদ্মনাম) কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলছিলেন এ কথা। কান্নার দমকে কথা আটকে গেলে তাঁর হাত থেকে মোবাইল ফোন নিয়ে আত্মীয় আলেয়া আক্তার বলেন, ‘নবী-রাসুলের দেশে সে এমন নির্যাতনের শিকার হইছে যে তা আর মুখে বলতে পারবে না।’

সৌদি আরব থেকে এখন প্রতি মাসে প্রায় ২০০ নারী গৃহকর্মী দেশে ফিরে আসছে। গত রবিবার রাতেও ফিরেছে ৪০। তাদের সবারই অভিজ্ঞতা কমবেশি একই রকম। শারীরিক-মানসিক নির্যাতন, এমনকি যৌন নির্যাতন চলেছে দিনের পর দিন। বিশাল সব সৌদি পরিবারে সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত বিরতিহীন কাজ করে যেতে হতো। ধন-সম্পদে ভরা বলে যে দেশটির কথা তারা এত দিন শুনে এসেছে, সেখানে তাদের ঠিকমতো খাবারও দেওয়া হতো না। ঢাকায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সৌদি ফেরত এই নারীরা বিমান থেকে নেমে এলে কান্নার রোল পড়ে। অনেকে শুধু ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে চারদিকে। বিশ্বাস ভঙ্গ আর নির্যাতনে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে অনেকে।

রিজিয়ার মতো একইভাবে পরিবারের সচ্ছলতা আনতে সৌদি আরব গিয়েছিলেন হবিগঞ্জ সদর উপজেলার জিতু মিয়ার মেয়ে খায়রুন্নেছা আক্তার। নির্যাতনের শিকার হয়ে দুই মাস ১০ দিন পর দেশে ফিরে এসেছেন। জিতু মিয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এমন নির্যাতন মানুষকে মানুষ কোনো দিন করে না। আমার মেয়েকে যাদের বাড়িতে কাজ করতে নিয়েছিল তারা অমানুষ।’ জিতু মিয়ার মেয়ের সঙ্গে সৌদি আরব থেকে ফিরে এসেছেন মৌলভীবাজারের মিলি আক্তার। তিনি বলেন, ‘আমার ওপর কী যে গেছে এখন সেই কথা মনে করতে চাই না। দেশে ফিরে এসেছি, বেঁচে আছি এতটুকুই জানি।’ এ কথা বলেও মিলি আক্তার মনে না করে পারেন না সেই কথা :  ‘শরীরের ব্যথায় এখনো রাতে ঘুম হয় না। সেখানকার কথা মনে হলেই মাথা ঝিমঝিম করে। আমি আর মনে করতে চাই না—বলেই কাঁদতে থাকেন তিনি। ক্ষুব্ধ কণ্ঠে এর পর তিনি বলেন, ‘দালালদের কথায় যেন আমার মতো কোনো মেয়ে সৌদি আরব না যায়। দালালরা কথা বলে একটা, সেখানে নিয়ে যাওয়ার পর করে আরেকটা।’

মোটা অঙ্কের বেতনের লোভ দেখিয়ে রিক্রুটিং এজেন্সির দালালরা শহর এবং গ্রামের নিরীহ নারীদের গৃহকর্মীর কাজে সৌদি আরবে পাঠায়। নির্যাতন সইতে না পেয়ে স্থানীয় পুলিশ, বাংলাদেশ দূতাবাস ও  স্বদেশি প্রবাসী পুরুষদের সহযোগিতায় দেশে ফিরে আসছে তারা। প্রতিদিনই বাংলাদেশ দূতাবাসের সেইফ হোম ও সৌদি ইমিগ্রেশন ক্যাম্পে আশ্রয় নিচ্ছে নারীরা। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, প্রতিদিনই ১৫০ থেকে ২৫০ জন নারীকর্মী ওই দেশের শেল্টার হোম বা ইমিগ্রেশন ক্যাম্পে আশ্রয় নিচ্ছে। আর প্রক্রিয়া শেষে মাসে প্রায় দুই শতাধিক নারীকর্মী দেশে ফিরে আসছে।

Manual8 Ad Code

চলতি মাসে প্রায় তিন শতাধিক নারীকর্মী দেশে ফিরেছে। এর মধ্যে ৭৫ জনের বেশি ফিরেছে ব্র্যাকের অভিবাসন বিভাগের সহযোগিতায়। আরো কিছু নির্যাতিত নারীকে দেশে ফিরিয়ে আনতে কাজ করে যাচ্ছে ব্র্যাকের এই বিভাগ। গত রবিবার (২৭ মে) রাতে সৌদি থেকে যে ৪০ জন নারীকর্মী দেশে ফিরে এসেছে তাদের মধ্যে সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার মমতাজ বেগম নির্যাতনের কারণে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন। তাঁর মতো নির্যাতনের শিকার হয়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে শেরেবাংলানগরের মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন আছেন মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর উপজেলার মনোয়ারা বেগম। মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন ফরিদপুরের কেতোয়ালির আমেনা বেগম ও আকলিমা বেগম, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুরের হালিমা বেগম ও নরসিংদীর ঝর্না আক্তার।

সৌদি ফেরত নারীকর্মীরা জানায়, হাতে গোনা কিছু বাড়ির কর্মী ছাড়া অধিকাংশ নারীকর্মীই নির্যাতনের শিকার হচ্ছে সৌদি আরবে। নির্যাতন সইতে না পেরে পালিয়ে আসছে, আবার অনেকেই মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে। নারীদের দেশটিতে পাঠানোর আগে সরকার যেন কঠোরভাবে বিষয়গুলো বিবেচনা করে। ঢাকার সাভারের ভাকুর্তার সালেহা বেগম বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে কোনো নারীকর্মী পাঠানোর অনুমোদন যেন সরকার না দেয়। আর কোনো মা এবং বোনেরা যেন দালালের কথায় সৌদি আরব না যায়। ওই দেশের পুরুষরা যে কতটা খারাপ সেটা সেখানে না গেলে কেউ বুঝবে না।’

অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থার একজন কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্তারা চোখ বন্ধ করে রেখেছেন। প্রতি মাসেই অনেকে নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফেরত এলেও তাঁরা এটা দেখছেন না। বাজার টিকিয়ে রাখতে নারীকর্মীদের ভয়ংকর নির্যাতনের দেশে পাঠানো হচ্ছে। গৃহকর্মীদের ওপর নির্যাতনের প্রতিবাদ জানিয়ে অনেক দেশ সৌদিতে নারীকর্মী পাঠানো বন্ধ করলেও বাংলাদেশ এসব নির্যাতনকে পাত্তাই দিচ্ছে না। ব্র্যাকের মাইগ্রেশন বিভাগের কর্মকর্তা মো. নয়ন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘রবিবার ফেরা ৪০ জন নারীকর্মীর মধ্যে মমতাজ বেগমসহ বেশ কয়েকজন মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন।’

বাংলাদেশ জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) সূত্রে জানা গেছে, গত জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত এই চার মাসে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে নারীকর্মী গেছে ৩৯ হাজার ৫৭৫ জন। এর মধ্যে সৌদি আরবেই গেছে ৩০ হাজার ১০২ জন, যা মোট নারীকর্মীর ৭৬ শতাংশ। জানুয়ারিতে সৌদি আরবে নারীকর্মী গেছে ৯ হাজার ১৭২ জন, ফেব্রুয়ারিতে সাত হাজার ৪৫২ জন, মার্চে চার হাজার ৯৮৬ জন ও এপ্রিলে আট হাজার ৪৯২ জন এবং চলতি মে মাসের ২২ তারিখ পর্যন্ত গেছে চার হাজারের বেশি। অন্যদিকে চলতি বছর এপ্রিল পর্যন্ত ওমানে নারীকর্মী গেছে তিন হাজার ৬৮১ জন, জর্দানে দুই হাজার ৮৯৬ জন, কাতারে এক হাজার ২৯২ জন, আরব আমিরাতে ৬৫৫ জন ও লেবাননে ৫৫২ জন। অন্য দেশগুলো থেকে নির্যাতনের শিকার হওয়ার অভিযোগে দেশে ফেরার সংখ্যা খুব কম। নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফেরা নারীকর্মীদের ৯৫ শতাংশই আসছে সৌদি আরব থেকে।

Manual4 Ad Code

সূত্রে আরো জানা গেছে, সৌদি আরবসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এ পর্যন্ত নারীকর্মী গেছে সাত লাখ ৩৫ হাজার ৫৭৫ জন। এর মধ্যে সৌদি আরবে নারীকর্মী গেছে দুই লাখ ৩৪ হাজার ৮৩১ জন, আমিরাতে আছে এক লাখ ২৬ হাজার ৬৫৬ জন, ওমানে ৬৮ হাজার ২৮৩ জন, লেবাননে এক লাখ চার হাজার ৭৫৯ জন ও জর্দানে এক লাখ ৩২ হাজার ৭১৬ জন।

সুনামগঞ্জের সোবাহান আলীর মেয়ে রেবা আক্তার সম্প্রতি সৌদি আরব থেকে দেশে ফিরে জানান, স্থানীয় দালাল মো. শহিদ মিয়ার মাধ্যমে ২০ হাজার টাকা বেতনের প্রলোভনে ৪০ হাজার টাকা খরচ করে তিনি সৌদি আরব যান। নির্যাতনে  টিকতে না পেরে পাঁচ মাস ১০ দিন পর দেশে ফেরেন তিনি। তাঁর বাবা সোবাহান আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিদেশে গিয়ে মেয়ে আমাদের কষ্ট দূর করতে চাইছিল, এখন সেই মেয়েই মরার মতো হয়ে গেছে। আর যাতে কেউ মেয়েকে সেখানে না পাঠায়।’

ভোলার শর্ষীনার হাসিনা বেগম বলেন, ‘প্রথম চার মাস বেতন পেয়েছিলাম, কিন্তু এরপর থেকেই শুরু হয় অত্যাচার আর অত্যাচার। সব কিছু মেনে নিয়েই এক বছর চাকরি করেছি, শেষমেশ এক দারোয়ানের সহযোগিতায় ক্যাম্পে পালিয়ে আসি।’ তিনি বলেন, ‘সৌদির বাংলাদেশ দূতাবাসের সেফ হোমে ১৩০ এবং ইমিগ্রেশনে আরো ৬০ জন নারী আমার মতো নির্যাতনের শিকার হয়ে পড়ে আছে। ওদের ভালো কোনো চিকিৎসার ব্যবস্থায় নেই ওখানে। এর মধ্যে রাবেয়া, ফুলমতি, ফরিদা, তাজলিমা গুরুতর অসুস্থ বলেও তিনি জানান।

ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘গড়ে দুই শ মেয়ে প্রতি মাসে ফেরত আসছে বাংলাদেশে। ইতিমধ্যে গত চার মাসে সাত-আট শ মেয়ে ফেরত এসেছে। ব্র্যাক গত কয়েক মাসে ১১৮ জন মেয়েকে দেশে ফেরত আনতে দূতাবাস, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয়। তাদের মধ্যে ৮০ জনকে আমরা ফেরত আনতে পেরেছি।’  এর বাইরেও ব্যক্তিগতভাবে অনেকে আসে এই সংখ্যাটা একদম কম হবে না। তিনি বলেন, গত দুই বছরে অন্তত হাজারখানেক মেয়ে ফিরে এসেছে, যাদের অধিকাংশই যৌন নির্যাতন বা অন্যান্য নির্যাতনের শিকার।

Manual5 Ad Code

মানবাধিকারকর্মী অ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেন, ‘সৌদি আরবে নারীকর্মীদের ওপর নির্যাতন বন্ধ করতে হলে সরকারকে কঠোর অবস্থান নিতে হবে এবং উভয় দেশের মধ্যে চুক্তি থাকতে হবে নারীকর্মীদের স্বার্থ রক্ষায়। এমনকি মেয়েদের সচেতন হতে হবে।

এ ব্যাপারে জানতে সৌদি আরবে বাংলাদেশ দূতাবাসের লেবার কাউন্সিলর গোলাম সরওয়ারের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।

Manual4 Ad Code

Sharing is caring!

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

বিজ্ঞাপন

আর্কাইভ

May 2018
S S M T W T F
 1234
567891011
12131415161718
19202122232425
262728293031  

সর্বশেষ খবর

………………………..