সুনামগঞ্জে ফসল রক্ষা বাঁধ ৪০ কোটি টাকা লুটের প্রস্তুতি!

প্রকাশিত: ২:৫৮ অপরাহ্ণ, মে ৯, ২০১৮

সুনামগঞ্জে ফসল রক্ষা বাঁধ ৪০ কোটি টাকা লুটের প্রস্তুতি!

ক্রাইম সিলেট ডেস্ক : সুনামগঞ্জের হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধের ৯৬৪টি প্রকল্পের ৮০ শতাংশই এবার এক্সকাভেটর মেশিন দিয়ে মাটি কাটা হয়েছে। পানিসম্পদমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু গত ১৯ জানুয়ারি সুনামগঞ্জের জোয়ালভাঙ্গা ও হালির হাওরে এক্সকাভেটর দিয়ে বাঁধে মাটি ভরাটের কাজ উদ্বোধন করেন। এই দুটিসহ হাওরের সব বাঁধেই শ্রমিকদের দিয়ে (ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে) মাটি কাটার কথা ছিল। তবে শ্রমিক সংকট ইত্যাদি কারণে দুই শতাধিক মেশিনে মাটি কাটা হয়; কিন্তু এখন ফসল রক্ষা বাঁধের পূর্ণ বিল তুলতে মাস্টার রোলে মেশিনের (এক্সকাভেটর) বদলে শ্রমিকের নাম বসিয়ে ম্যানুয়াল পদ্ধতি অনুসরণ করে ৮০ শতাংশ প্রকল্পের বিল তোলার প্রস্তুতি চলছে। এটি হলে সরকারের প্রায় ৪০ কোটি টাকা গচ্চা যাবে।

এদিকে শ্রমিকদের বদলে এক্সকাভেটর দিয়ে মাটি কাটানোয় সমন্বয় করে বিল করে প্রতিবেদন দিতে ১১ ফসল রক্ষা বাঁধের উপজেলা কমিটির সভাপতি ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) চিঠি দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো); কিন্তু সভাপতিরা এখনো চিঠির উত্তর দেননি।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০১৭ সালের সংশোধিত কাজের বিনিময়ে টাকা (কাবিটা) নীতিমালায় নির্ধারিত দূরত্ব থেকে শ্রমিক ও এক্সকাভেটর দিয়ে মাটি কাটার জন্য সরকার আলাদা রেট নির্ধারণ করেছিল; কিন্তু কাজের সময় সেটা মানা হয়নি। বাঁধের গোড়া থেকে আর শ্রমিকের বদলে মেশিন ব্যবহার করে মাটি কেটে টাকা পকেটে পোরার প্রস্তুতি নিয়েছে সব প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি)। এই টাকা ঢুকবে ইউএনও, পাউবোর উপসহকারী প্রকৌশলী, ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও প্রকল্পের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকসহ একটি সুবিধাবাদী গোষ্ঠীর পকেটে।

সুনামগঞ্জ পাউবো সূত্রে জানা যায়, ২০১৭ সালে হাওরের সম্পূর্ণ বোরো ফসল তলিয়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সরকার কাবিটা নীতিমালা-২০১৭ প্রণয়ন করে। এ প্রথায় ঠিকাদারি বাদ দিয়ে হাওরের সুবিধাভোগী কৃষকদের মাধ্যমে ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণের নির্দেশনা ছিল। নতুন নীতিমালায় জেলা প্রশাসককে কাবিটা বাস্তবায়ন ও মনিটরিং কমিটির সভাপতি এবং পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলীকে সদস্যসচিব করা হয়। প্রতিটি উপজেলায় ইউএনওদের সভাপতি ও সংশ্লিষ্ট উপসহকারী প্রকৌশলীকে সদস্যসচিব করে কমিটি করা হয়। কমিটিতে বাঁধ এলাকার জমির মালিক থাকার কথা থাকলেও বেশির ভাগ প্রকল্পেই সেটা মানা হয়নি। এবার ৫২টি হাওরে ৯৬৪টি প্রকল্পের মধ্যে ৮ শতাংশ প্রকল্পের কাজ ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে এবং ২০ শতাংশ কাজ মেশিন দিয়ে করানোর প্রাক্কলন ছিল; কিন্তু ৮০ শতাংশ কাজ মেশিনে ও ২০ শতাংশ কাজ শ্রমিক দিয়ে হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা কমিটির সদস্যসচিব।

প্রকল্পের নীতিমালা অনুযায়ী প্রায় ১০০ ফুট দূরত্ব থেকে শ্রমিক দিয়ে মাটি কাটলে প্রতি ঘনমিটার মাটির জন্য প্রায় ১৬৮ টাকা বিল ধরা হয়। আর এক্সকাভেটরে কাটা মাটির জন্য ধরা হয়েছে ১১৮ টাকা। নীতিমালায় প্রথমবারের মতো ঘাস লাগানোর জন্য প্রতি বর্গমিটারে প্রায় ২৬ টাকা নির্ধারণসহ কমপেকশন ও ঘাস লাগানোর জন্য ৪৩ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। কোনো পিআইসিই নীতিমালা অনুযায়ী পুরো বাঁধে ঘাস লাগায়নি, কমপেকশন করেনি এবং নির্ধারিত দূরত্ব থেকে মাটি কাটেনি।

পাউবো, প্রত্যক্ষদর্শী কৃষক ও এলাকাবাসী জানান, নানা সমস্যার কারণে শ্রমিকদের বদলে হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধে মাটি কাটার জন্য এবার দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রায় ২০০ এক্সকাভেটর আনা হয়েছিল। প্রতিটি বাঁধে এই মেশিনে কাজ করেছে। সরকারের মোটা অঙ্কের টাকা পকেটে তুলতে মেশিনের বদলে এখন শ্রমিকের নাম মাস্টার রোলে ঢোকানোর প্রস্তুতি চলছে।

পাউবো সূত্র জানায়, এবার ৭৭৩ কিলোমিটার বাঁধে সরকার প্রায় ১৭৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। বরাদ্দের ১৩৫ কোটি ছাড় দেওয়া হয়েছে। বাকি বরাদ্দও দেওয়া হবে বলে ৩ এপ্রিল সুনামগঞ্জ সার্কিট হাউসে এক মতবিনিময়সভায় ঘোষণা দেন পাউবোর মহাপরিচালক মো. মাহফুজুর রহমান।

জানা গেছে, ফসল রক্ষা বাঁধে নিয়োজিত কাবিটা বাস্তবায়ন ও মনিটরিং জেলা কমিটির সদস্যসচিব মো. আবু বকর সিদ্দিক ভূঁইয়া ১ মার্চ এ কাজের বিল পরিশোধ বিষয়ে প্রতিটি ইউএনও ও বাঁধের উপজেলা কমিটির সভাপতি বরাবর চিঠি দেন। চিঠিতে উল্লেখ করেন, নীতিমালা অনুযায়ী কোথাও কমপেকশন করা হচ্ছে না এবং এক্সকাভেটর দিয়ে বাঁধের গোড়া থেকে মাটি কাটা হচ্ছে। প্রাক্কলনে শ্রমিক দিয়ে মাটি কাটার উল্লেখ থাকলেও এক্সকাভেটরে মাটি কাটা হচ্ছে। এ বিষয়ে সমন্বয় করে কাজের প্রকৃত বিল পরিশোধের বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে বাঁধের উপজেলা কমিটির সভাপতি ও ইউএনওদের বলা হলেও এখনো তাঁরা এর উত্তর দেননি।

জামালগঞ্জের হালির হাওরের ৯২ নম্বর পিআইসির সভাপতি সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘আমার বাঁধটিতেও মেশিন দিয়ে মাটি কাটিয়েছি। এখন ১৫০ জন শ্রমিকের নামে আমরা মাস্টাররোল প্রস্তুত করছি।’

এদিকে মেশিনের বদলে শ্রমিক দেখিয়ে মাস্টাররোল করতে অনেক ইউএনওই আপত্তি জানিয়েছেন। এটা করলে তাঁরা আইনি সমস্যায় পড়তে পারেন বলে আশঙ্কা করছেন। জগন্নাথপুর উপজেলা ফসল রক্ষা বাঁধ কমিটির সভাপতি ও ইউএনও মাছুম বিল্লাহ বলেন, ‘আমার এলাকায় প্রায় ১৫-২০ ভাগ শ্রমিক দিয়ে ও বাকি কাজ মেশিনে হয়েছে। এখন বিলের সমন্বয় করতে সমস্যা হচ্ছে।’

পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আবু বকর সিদ্দিক ভূঁইয়া বলেন, ‘ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে মাটি কাটার কথা থাকলেও সেটা মানা হয়নি। কমপেকশনও করা হয়নি। নির্ধারিত দূরত্ব থেকে মাটি কাটা হয়নি। তিনি বলেন, ‘শ্রমিক দেখিয়ে মাস্টাররোল তৈরি করে বিল তুললে সরকারের প্রায় ৪০ কোটি টাকা অপচয় হবে। বিষয়টি আমি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি।’

Sharing is caring!

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

বিজ্ঞাপন

আর্কাইভ

May 2018
S S M T W T F
 1234
567891011
12131415161718
19202122232425
262728293031  

সর্বশেষ খবর

………………………..