আমাকে কেউ বিয়ে করবে জীবনেও ভাবিনি

প্রকাশিত: ৫:৩২ অপরাহ্ণ, মে ১, ২০১৮

আমাকে কেউ বিয়ে করবে জীবনেও ভাবিনি

ক্রাইম সিলেট ডেস্ক : দুঃখের জীবনের ইতি টেনে অবশেষে নতুন জীবন শুরু করলেন আলো আক্তার (২০) নামের সেই এতিম গৃহকর্মী। রোববার রাতে পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার সাকোয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে অনাড়ম্বর এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিয়ে দেয়া হয় আলো আক্তারকে।

তার বিয়েতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, রাজনীতিক, সাংবাদিক, গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ ছাড়াও সাকোয়া এলাকার বিভিন্ন স্তরের মানুষের সরব উপস্থিতি ছিল।

নামকরা ডেকোরেটরের মাধ্যমে সুসজ্জিত করা হয় মুগ্ধকর তোরণ, বিশাল প্যান্ডেল আর সাজানো হয় বর-কনের স্টেজ। বিদ্যালয়ের মাঠজুড়ে বিকেল থেকেই শুরু হয় বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা।

সাকোয়া বাজারজুড়ে ছিল বিয়ের আমেজ। আলোর জীবন আলোকিত করতে বরযাত্রী নিয়ে রাত ৮টায় বরবেশে আসেন আমিনুল ইসলাম (৩০)।

বর আমিনুল ইসলাম পেশায় দিনমজুর। কখনও কখনও তাকে ঝালমুড়ি আর আইসক্রিম বিক্রেতা হিসেবেও দেখা যায়। আমিনুল ইসলাম দেবীগঞ্জ উপজেলার সোনাহার ইউনিয়নের মোজাম্মেল হকের ছেলে।

সবার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ, আপ্যায়ন আর বাদ্য বাজনায় পূর্ণতা পায় বিয়ের আমেজ। বিয়েতে আপ্যায়ন করা হয় তিন শতাধিক অতিথিকে। নগত টাকাসহ যথা নিয়মে উপহার সামগ্রী দেন অতিথিরা।

নতুন জীবনে পথচলায় আলোর দুই চোখজুড়ে ছিল আনন্দ অশ্রু। কান্নাজড়িত কণ্ঠে আলো বলেন, কখনও ভাবিনি আমার গায়ে হলুদের ছোঁয়া লাগবে। লাল টুকটুকে শাড়ি পরে বিয়ের পিঁড়িতে বসবো। কোনো এক রাজপুত্র এসে বিয়ের সানাই বাজিয়ে আমাকে বউ করে ঘরে তুলবেন। এ যেন অধরা স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন আজ বাস্তব।

Panchagarh1

স্থানীয় মিল চাতাল ব্যবসায়ী হাফিজুর রহমান ও স্থানীয় শিক্ষক একেএম মাসুদুর রহমানের উদ্যোগে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা ও সহযোগিতায় ছিলেন সাকোয়া ইউপি চেয়ারম্যান সায়েদ জাহাঙ্গীর হাসান সবুজ, জেলা পরিষদ সদস্য জাকির হোসেন, মমিনুল ইসলাম বুলেট, কাদেরুল ইসলাম ও আবুল বাসার বিপ্লব রহমান প্রমুখ।

সাকোয়া ইউপি চেয়ারম্যান ও স্থানীয়রা জানায়, প্রায় ২৫ বছর আগে অজ্ঞাত স্থান থেকে সাকোয়া এলাকায় আসেন আলো আক্তারের মা মর্জিনা বেগম (৪৫)। ওই সময় তিনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন। স্থানীয়রা তাকে মর্জিনা পাগলি বলেই ডাকতেন। মূলত বিবেক বিবর্জিত পথভ্রষ্টদের আগ্রহে অন্ধকার জগতে বিচরণ শুরু হয় মর্জিনা পাগলির।

তবে এর মধ্যেও মর্জিনা পাগলির সঙ্গে সখ্যতা গড়ে ওঠে স্থানীয় আফাজুল ইসলামের। মর্জিনা পাগলি বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ফিরে দিন শেষে আশ্রয় নিতেন সাকোয়া ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রের বারান্দায়। সেখানে অবস্থানকালে জন্ম হয় আলো আক্তারের। শিশুকাল থেকেই আলো অন্যের বাসায় গৃহকর্মীর কাজ করতেন।

তবে সামাজিক মর্যাদা নিয়ে কোথাও টিকতে পারেননি আলো আক্তার। ৮-৯ মাস আগে মায়ের কাছে ফিরে আসেন আলো। এরপর থেকেই মেয়ের বিয়ের জন্য স্থানীয়দের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে থাকেন মর্জিনা বেগম।

তার মেয়ে আলো আক্তারও একটি অন্ধকার জগতের স্থায়ী বাসিন্দা হতে পারেন এমন আশঙ্কায় অস্থির ছিলেন মা মর্জিনা বেগম। জাগ্রত বিবেকের স্থানীয় মানুষরাও চেষ্টা করতে থাকেন আলোকে বিয়ে দিতে।

Panchagarh1

খুঁজতে থাকেন আলোর জন্য পাত্র। অবশেষে এক আইসক্রিম বিক্রেতা মজিবুল হকের কাছে উপযুক্ত বরের খোঁজ পান ব্যবসায়ী হাফিজুর রহমান, একেএম মাসুদুর রহমানসহ স্থানীয়রা। তারা বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যান স্থানীয় জনপ্রতিনিধি সাকোয়া ইউপি চেয়ারম্যান সায়েদ জাহাঙ্গীর হাসান সবুজ ও জেলা পরিষদ সদস্য জাকির হোসেনের কাছে। পরে বিয়ের প্রস্তাব যায় বরের কাছে।

অবশেষে এক লাখ ৫০ হাজার ১০০ টাকা দেনমোহরে ধুমধাম করে বিয়ে দেয়া হয় আলো আক্তারের। সরকারি নিয়মে রেজিস্ট্রি করে বিয়ে পড়ান স্থানীয় কাজি আব্দুল হামিদ।

বিয়েতে উকিল দেন (সাক্ষী) স্থানীয় মাছ ব্যবসায়ী আব্দুস সালাম। বিয়ের রেজিস্ট্রারে বাবার নাম হিসেবে আফাজুল ইসলামের নাম উল্লেখ করা হয়।

তবে এ নিয়ে কোনো আপত্তি করেননি আফাজুল ইসলাম। সমাজ সংস্কারে এগিয়ে আসা মানুষরা বিয়ে পরবর্তী আলো-আমিনুল দম্পতির বসবাসের ব্যবস্থাও করেন দেন। তারা পানি উন্নয়ন বোর্ডের জায়গায় অস্থায়ী দুটি শোবার ঘরের পাশাপাশি রান্নাঘর এবং শৌচাগারের ব্যবস্থা করেন।

স্থানীয় ব্যবসায়ী হাফিজুর রহমান বলেন, আলো আক্তার শিশুকাল থেকেই অন্যের বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করতো। ৮-৯ মাস আগে মায়ের কাছে ফিরে আসে আলো। তারা অনেক সময় আমার মিল চাতালেই থাকতেন। আমিও তাদের নিয়ে চিন্তিত ছিলাম। তার মা মর্জিনা একাধিকবার আমার কাছে মেয়েকে বিয়ে দেয়ার কথা বলেছিলেন। আমরা সবাই মিলেই আলোর জন্য পাত্রের খোঁজ করছিলাম। এক আইসক্রিম বিক্রেতার মাধ্যমে আমরা বরের সন্ধান পাই। অবশেষে সবার সহযোগিতায় ধুমধাম করে আলোর বিয়ে দেয়া হয়।

সাকোয়া এলাকার স্থানীয় কিন্ডার গার্টেন শিক্ষক একেএম মাসুদুর রহমান বলেন, আইসক্রিম বিক্রেতা মজিবুল হকের কাছে পাত্রের সন্ধান পেয়ে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আমরা ইউপি চেয়ারম্যানের কাছে যাই। বিয়েতে সাকোয়া এলাকার সর্বস্তরের মানুষ আর্থিক সহায়তা ছাড়াও নানাভাবে সহযোগিতা করেন। এখন আমরা সম্মিলিতভাবে সরকারি জায়গায় তাদের বসবাসের জন্য একটি বাড়ির কাজ করছি। আশা করি দু’একদিনের মধ্যে বাড়ির কাজ সম্পন্ন হবে।

ইউপি চেয়ারম্যান সায়েদ জাহাঙ্গীর হাসান সবুজ বলেন, মেয়েটির প্রকৃত পিতৃপরিচয় পাওয়া যায়নি। তবে বিয়ের রেজিস্ট্রারে আমরা আফাজুল ইসলামের নাম ব্যবহার করেছি। এ নিয়ে তিনি কোনো আপত্তি করেননি। বিয়ের আগে তিনিও আমাদের সঙ্গে বরের বাড়িঘর দেখতে যান। সবার সহযোগিতায় কাজটা করতে পেরেছি।

তিনি আরও বলেন, বিয়ের সময় উপহার হিসেবে কিছু নগদ টাকা আমাদের হাতে এসেছে। অনেকে আর্থিকভাবে সহযোগিতা করেছেন এবং এখনও করছেন। আমরা তাদের জন্য স্থায়ী বসবাসের ব্যবস্থাসহ আমিনুল ইসলামের দৈনন্দিন আয়ের জন্য একটা কিছুর ব্যবস্থা করে দেব।

Sharing is caring!

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

বিজ্ঞাপন

আর্কাইভ

May 2018
S S M T W T F
 1234
567891011
12131415161718
19202122232425
262728293031  

সর্বশেষ খবর

………………………..