সিলেট ৪ঠা অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৯শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ৩০শে রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি
প্রকাশিত: ৬:৩২ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ৮, ২০১৮
ক্রাইম সিলেট ডেস্ক : হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জের চাঞ্চল্যকর বিউটি হত্যা মামলার রহস্য উদঘাটন হয়েছে। বিউটির বাবা ছায়েদ আলীর জবানীতে বেড়িয়ে এসেছে লোমহর্ষক তথ্য। তিনি স্বীকার করেছেন বিউটিকে নিজেই তুলে দিয়েছেন খুনিদের হাতে।
মাত্র ১০ হাজার টাকায় কিলিং মিশনে অংশ নেয় ভাড়াটে এক খুনি। আদালতের বরাত দিয়ে এমন তথ্যই নিশ্চিত করেছেন হবিগঞ্জের পুলিশ সুপার বিধান ত্রিপুরা। দ্রুত গ্রেফতারের স্বার্থে নাম পরিচয় গোপন করে তিনি জানান, ভাড়াটে ওই খুনিকে খুঁজছে পুলিশ।
শনিবার সন্ধ্যায় পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে প্রেস ব্রিফিংকালে পুলিশ সুপার বলেন, ‘গ্রাম্য রাজনীতির বলি হয়েছেন বিউটি। এই হত্যাকান্ডের সাথে রংপুরের আইনজীবী হত্যাকান্ডের অনেক সাদৃশ্য রয়েছে। স্বাধীনতার মাস মার্চে লাল সবুজের পতাকায় বিউটির হত্যা নিয়ে যে পোস্টটি সারাদেশে ভাইরাল হয় তদন্তে এর সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র পাওয়া গেছে। তাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোন কিছু ভাইরাল হলে মামলা এবং তদন্তে মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটে’।
তিনি জানান, শনিবার সকাল ১০টা থেকে বিকাল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত হবিগঞ্জ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তৌহিদুল ইসলামের আদালতে মামলার বাদী ও নিহত বিউটির বাবা ছায়েদ আলী ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। পরে প্রতিবেশী এবং ময়না মিয়ার স্ত্রী আছমা আক্তারের বক্তব্যও রেকর্ড করে আদালত।
এরপূর্বে বৃহস্পতিবার প্রথম দফায় দায়েরকৃত ধর্ষণ মামলার সাক্ষী বিউটির চাচা ময়না মিয়াকে আটক করে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এসব জিজ্ঞাসাবাদেই বেরিয়ে আসে নতুন তথ্য। শেষ পর্যন্ত ময়না মিয়া শুক্রবার বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিকে হত্যাকান্ডে নিজের জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেন। প্রকাশ করেন জড়িত অন্যান্যদের নামও।
এদিকে, হত্যার ঘটনায় বিউটির নানী ফাতেমা বেগমও সাক্ষী হিসেবে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। একই সময়ে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন গ্রেফতারকৃত বাবুল মিয়া। তিনি প্রথম দফায় বিউটিকে ধর্ষণের কথা স্বীকার করলেও হত্যাকান্ডে তার সংশ্লিষ্টতা নেই বলে আদালতকে জানিয়েছেন।
অপরদিকে, বাবুলের মা ইউপি সদস্য কলম চান বিবিকে দুইদিনের রিমান্ড শেষে শুক্রবার রাতে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। বিউটির মা হুসনা বেগম ও বিউটির ভাই সাদেক মিয়া পুলিশ হেফাজতে রয়েছে।
পুলিশ সুপার আরও জানান, বিউটিকে ধর্ষণকারী বাবুল মিয়া অলিপুরে প্রাণ কোম্পানীতে সুপারভাইজার হিসাবে চাকুরী করে। তার মা বিগত ইউপি নির্বাচনে সংরক্ষিত মহিলা সদস্য নির্বাচিত হন। ফলে এলাকায় তার অর্থ এবং প্রভাব রয়েছে। তবে সে দুশ্চরিত্রের লোক। এক প্রবাসীর স্ত্রীকে সে ইতোপূর্বে বিয়ে করে। একই এলাকার ছায়েদ মিয়ার মেয়ে বিউটি আক্তার স্থানীয় মোজাহের উচ্চ বিদ্যালয়ের ৭ম শ্রেণীতে পড়ত। বাবুলের কুদৃষ্টি পরে তার উপর।
তিনি বলেন, পরে বিউটির সাথে প্রেমের সম্পর্ক করে তাকে বিয়ের প্রলোভন দেখায় বাবুল। বাবুল অলিপুর এলাকায় এক হাজার টাকায় একটি রুম ভাড়া নিয়ে গত ২১ ফেব্রুয়ারী থেকে ৯ মার্চ পর্যন্ত বিউটিকে নিয়ে স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে বসবাস করে। ৯ ফেব্রুয়ারী বিউটিকে প্রাণ কোম্পানীতে চাকুরী দিবে বলে সেখানে নিয়ে যায়। খবরটি জানতে পারেন বিউটির মা প্রাণ কোম্পানির কর্মী হুসনা বেগম।তিনি এবং বিউটির বাবা ছায়েদ মিয়া প্রাণ কোম্পানীতে গিয়ে মেয়েকে উদ্ধার করেন।
বিষয়টি জানাজানি হলে এলাকায় সালিশের মাধ্যমে নিস্পত্তির চেষ্টা করা হয়। কিন্তু বাবুল বিউটিকে বিয়ে করতে রাজী না হওয়ায় সালিশে কোন সমাধান হয়নি। এরপর বিউটিকে হবিগঞ্জ আধুনিক জেলা সদর হাসপাতালে ভর্তি করে ৩দিন রাখা হয়। ১৪ ফেব্রুয়ারী আদালতে অপহরণসহ ধর্ষনের অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়। মামলাটি ৪ মার্চ শায়েস্তাগঞ্জ থানায় এফআইআর করা হয়।
এরই মাঝে ১২ মার্চ আবারও ইউপি চেয়ারম্যান জজ মিয়ার নেতৃত্বে সালিশের মাধ্যমে বিষয়টি নিস্পত্তির উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু মামলা হওয়ায় কোন সালিশ হয়নি। ১২ মার্চ বিউটিকে থানায় আনা হয়। পরে মেডিকেল করার পর আদালতে সে ২২ ধারায় জবানবন্দি দেয়। বাবুল মিয়া তাকে বিয়ে করলে মামলা তুলে নিবে বলেও সেখানে জানায়।
এদিকে, বিউটিকে বাড়ীতে আনার পর দিশেহারা হয়ে পড়েন বাবুলের বাবা ছায়েদ মিয়া। বাড়ীতে মেয়েকে না রেখে পাঠিয়ে দেয়া হয় লাখাই উপজেলার গুণিপুর গ্রামে তার নানী ফাতেমা বেগমের বাড়িতে। এই সুযোগে নতুন করে ফন্দি আটেন ময়না মিয়া।
বিগত ইউপি নির্বাচনে ব্রাহ্মণডোরা ইউনিয়নের ৪, ৫ ও ৬ নং ওয়ার্ড থেকে সংরক্ষিত নারী আসনের মেম্বার পদে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন আওয়ামীলীগ নেতা ময়না মিয়ার স্ত্রী আসমা আক্তার ও বাবুলের মা কলম চান বিবি। কথা ছিল কলমচান বিবি নির্বাচনে অংশ না নিয়ে আসমা আক্তারকে ছাড় দিবেন। শেষ পর্যন্ত কথা না রেখে কলমচান বিবি নির্বাচনে অংশ নেন এবং তার কাছে পরাজিত হন ময়না মিয়ার স্ত্রী আসমা আক্তার। এরপর থেকেই উভয় পরিবারের মধ্যে দ্বন্দ চলে আসছে। এরই জেরধরে বিউটিকে অপহরণের পর ধর্ষণের ঘটনার মামলায় স্বাক্ষী হন ময়না মিয়া। মামলায় আসামী করা হয় বিজয়ী মেম্বার কলম চান বিবি ও তার পুত্র বাবুল মিয়াকে।
আদালতের বরাত দিয়ে পুলিশ সুপার জানান, ধর্ষণের ঘটনার পর থেকে ময়না মিয়া প্রায়ই সায়েদ মিয়াকে বোঝাতে থাকেন, ‘বাবুল যদি বিউটিকে বিয়ে না করে তাহলে এই নষ্ট মেয়েকে কেউ বিয়ে করবে না। অন্য সন্তানদেরও আর বিয়ে হবে না। এর চেয়ে যদি বিউটিকে মেরে বাবুল মিয়া ও তার মা কলম চান বিবিকে ফাঁসানো হয় তাহলে প্রতিশোধও নেয়া হবে এবং তার অন্য সন্তানরা রক্ষা পাবে’।
এক পর্যায়ে ময়না মিয়ার প্রলোভনের ফাঁদে পা দেয় সায়েদ মিয়া। ময়না মিয়া ১০ হাজার টাকায় একজন পেশাদার খুনিকে ভাড়া করে এবং আড়াই হাজার টাকা অগ্রীম প্রদান করে। পরে ঘটনার দিন রাতে সায়েদ মিয়া, বাবুল মিয়া ও ভাড়াটে খুনি গুণিপুর গ্রামে গিয়ে বিউটির নানী ফাতেমা বেগমকে বলে মেয়েকে চেয়ারম্যান এর কাছে নেয়ার জন্য সে এসেছে। পরে লাখাই উপজেলার হরিণাকোন গ্রামে রাত ২টার দিকে বিউটিকে হত্যা করা হয়। ভাড়াটে খুনি বিউটির হাত পা বেধে রাখে এবং ময়না মিয়া ছুরি দিয়ে ৫টি আঘাত করে হত্যা করে। পরে রক্ত ধুয়ে লাশটি হাওরে ফেলে রাখা হয়। ময়না মিয়া এলাকায় আদম ব্যবসায়ী হিসাবে পরিচিত। ঘটনা শুনে ১৭ মার্চ নানী ফাতেমা বেগম বিউটির বাড়ীতে আসলে তাকে শাশিয়ে দেয়া হয় কোন কিছু না বলার জন্য।
পুলিশ সুপার আরও জানান, মেয়ে হত্যার পর একজন পিতার যে অনুভূতি থাকার কথা ছিল তা তার চেহারায় তা ছিল না। তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে তার এবং ময়না মিয়ার গুণিপুর গ্রামে উপস্থিতির প্রমাণ এবং তাদের আচরণে সন্দেহ হলে পুলিশ তাদেরকে আটক করে। ভাড়াটে খুনিকে ধরতে পুলিশ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাকে গ্রেফতার করতে পারলেই সকল পরিকল্পনাকারী এবং হত্যাকারীকে আইনের আওতায় এনে অভিযোগ পত্র দাখিল করে বিচার শুরু করা যাবে।
এক প্রশ্নের জবাবে পুলিশ সুপার জানান, বাবুল মিয়া সরাসরি হত্যায় জড়িত না থাকলেও তার কারনেই এই ঘটনা ঘটেছে। অবশ্যই তাকে প্রধান অভিযুক্ত হিসেবে মামলার অভিযোগপত্রে রাখা হবে।
উল্লেখ্য, শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলার ব্রাহ্মণডোরা গ্রামের সায়েদ আলীর মেয়ে বিউটি আক্তারকে (১৬) কে অপহরণ করে ধর্ষণ করে একই গ্রামের ইউপি মেম্বার কলম চান বিবির ছেলে বাবুল মিয়া। এ ঘটনায় ৪ মার্চ হবিগঞ্জ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালতে বাবুল ও তার মা কলম চান বিবির বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেন সায়েদ আলী। ওই মামলায় স্বাক্ষী করা হয় সায়েদ আলীর ঘনিষ্ট আত্মীয় ময়না মিয়াকে।
এ ঘটনার পরই বিউটিকে পাঠিয়ে দেয়া হয় লাখাই উপজেলার গুণিপুর গ্রামে তার নানী ফাতেমা বেগমের বাড়িতে। গত ১৬ মার্চ রাতে সেখান থেকে নিখোঁজ হয় বিউটি। পরদিন ১৭ মার্চ গুণিপুর গ্রাম থেকে প্রায় ৪ কিলোমিটার দূরে শায়েস্তাগঞ্জের হাওরে তার লাশ পাওয়া যায়। এ সময় তার শরীরের একাধিক স্থানে আঘাতের চিহ্ন দেখতে পায় পুলিশ। পরে এ ঘটনায় ১৮ মার্চ বিউটির বাবা সায়েদ আলী বাদী হয়ে একই গ্রামের বাবুল মিয়া (৩২) ও তার মা ইউপি সদস্য কলম চান বিবিকে (৪৫) আসামি করে শায়েস্তাগঞ্জ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।
এরপর পুলিশ অভিযান চালিয়ে কলম চান বিবিকে শায়েস্তাগঞ্জ নতুন ব্রীজ এবং বাবুলের বন্ধু ইসমাইল মিয়াকে অলিপুর থেকে গ্রেফতার করা হয়। ধর্ষণের পর হত্যাকান্ডের ঘটনাটি এবং হাওরে বিউটির রক্তাক্ত লাশের ছবি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকসহ সর্বত্র ভাইরাল হয়ে যায়। দেশ বিদেশের গণমাধ্যমে আলোচিত এ সংবাদটি প্রচার হলে গত ৩০ মার্চ সিলেট থেকে বাবুল মিয়া কে গ্রেফতার করে র্যাব।
বাবুলকে গ্রেফতারের পর প্রতিবাদের ঝড় উঠে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ গণমাধ্যমে। ধর্ষণ ও হত্যায় জড়িতদের শাস্তির দাবিতে উত্তাল হয়ে উঠে সারাদেশ। পুলিশও হত্যার মোটিভ উদঘাটনে মরিয়া হয়ে ওঠে। দ্বিতীয় দফায় চাঞ্চল্যকর এ মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব পান শায়েস্তাগঞ্জ থানার ওসি (তদন্ত) মানিকুল ইসলাম। দায়িত্ব নেয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই তিনি মোটিভ উদঘাটনে সক্ষম হন তিনি।
Sharing is caring!
………………………..
Design and developed by best-bd