প্রতারণায় অভিযুক্ত তানজিলা হক

প্রকাশিত: ৯:২৯ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ৬, ২০১৮

প্রতারণায় অভিযুক্ত তানজিলা হক

ক্রাইম সিলেট ডেস্ক : রোমানিয়ায় গার্মেন্টস কারখানায় আকর্ষণীয় বেতনে চাকরি। থাকা কোম্পানি বহন করবে। সঙ্গে আট ঘণ্টা ডিউটির পাশাপাশি থাকবে আরও দুই ঘণ্টা ওভারটাইম করার সুযোগ। এমন প্রলোভন দেখিয়ে ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আহাম্মেদ এক্সপোর্ট করপোরেশন ও আহাম্মেদ গার্মেন্টস ট্রেডিং সেন্টার নামের দুটি প্রতিষ্ঠান চাকরির বিজ্ঞাপন দেয়। সেই বিজ্ঞাপনের ব্যানার ও লিফলেট সাটানো হয়েছিল চট্টগ্রাম ইপিজিজেড এলাকার দুটি গেটে। বিজ্ঞাপন দেখে ভালো বেতনে রোমানিয়ায় চাকরির সুযোগ হাতছাড়া করতে চায়নি চাকরি প্রত্যাশীরা। আবেদন করতে হামলে পড়েন অনেক যুবক। আবেদনের পর চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ কনভেনশন হলের ফাতেমা হাইটসের দ্বিতীয় তলায় তাদের মৌখিক পরীক্ষার ব্যবস্থাও করা হয়। এরপর বিদেশ পাঠানোর খরচ বাবদ ৪৬ যুবকের কাছ থেকে আড়াই লাখ থেকে শুরু করে ৪ লাখ টাকা পর্যন্ত ব্যাংকের মাধ্যমে ও ক্যাশ টাকা নেওয়া হয়। আর এসব টাকা ক্যাশ ও ব্যাংকের মাধ্যমে নেন প্রতিষ্ঠানটির হিসাবরক্ষক তানজিলা হক।

প্রায় সাত মাস পর ২০১৭ সালের ১৯ এপ্রিল ৪৬ জনকে ঢাকায় ডেকে হাতে তুলে দেওয়া হয় পাসপোর্ট। সেদিন তাদের রোমানিয়া যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আর যাওয়া হয়নি। অভিযোগ আছে ঢাকার পুরানা পল্টন এলাকার কিছু মাস্তানের মাধ্যমে কেড়ে নেওয়া হয় তাদের পাসপোর্ট। বিদেশ পাঠানোর প্রায় চার কোটি টাকা নিয়ে প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়ে লাপাত্তা হয়ে যান প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা। ওই ৪৬ যুবক বুঝতে পারেন তারা বিদেশে চাকরির নামে প্রতারিত হয়েছেন। পরে বিষয়টি পুলিশকে জানালেও তেমন কিছুই হয়নি। উদ্ধার করা যায়নি সেই টাকাও।

এ ঘটনার পর তাদের মধ্যে মামুন নামে এক যুবক পল্টন থানায় একটি প্রতারণার মামলা করেন। সেই মামলার তদন্ত করতে শুরু করে পুলিশ। এবার তদন্তে নেমে বেরিয়ে আসে, আহাম্মেদ এক্সপোর্ট করপোরেশন ও আহাম্মেদ গার্মেন্টস ট্রেডিং সেন্টার নামে কোনো প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব নেই। তারা রাজধানীর পুরানা পল্টন এলাকার ৪৬ /এ নম্বরের আবাসিক ভবনে ভুয়া নামে অফিস ভাড়া নিয়েছিল। পুলিশের তদন্তে প্রতারণার বিষয়টি সত্য বলে প্রমাণিত হয়।

এখানেই শেষ নয়, ৪৬ যুবককে রোমানিয়ার যে ভিসা দেওয়া হয়েছিল সেগুলো ছিল ভুয়া। আর এই ভিসা বাবদ নেওয়া হয়েছিল প্রতি জনের কাছ থেকে দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা, পুলিশ ভেরিফিকেশন বাবদ চার হাজার টাকা ও জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের নামে দেড় হাজার টাকা।

ভুক্তভোগীরা জানায়, টাকা নেওয়ার কাজটা হতো মূলত তানজিলার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ছাড়াও সে ওই সকল যুবকদের কাছে নগদ টাকাও নিতেন। এ ঘটনার পর থেকে পলাতক ছিলেন তানজিলা রুম্মান। সম্প্রতি তাকে বিমানবন্দর এলাকায় ঘোরাফেরা করতে দেখে ভুক্তভোগীদের একজন তানজিলাকে আটক করেন। আটকের পর তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়। তবে প্রতিষ্ঠানটির মূল ব্যক্তি ইউরোপের দেশ ইতালি থেকে ফ্রান্সে পালিয়ে গেছেন বলে জানান তানজিলা।

তিনি আরও জানান, প্রতিষ্ঠানটির মালিক পুরানা পল্টনে অফিস ভাড়া নেওয়ার সময় টঙ্গিএলাকার বোর্ড বাজারের ভুয়া ঠিকানা দেন। তিনি ভবন মালিকের সঙ্গে যে ডিড করেছিলেন তা পরবর্তী সময়ে বাতিল করে দ্রুত মালামাল নিয়ে সটকে পড়েন। আর এতে পল্টন থানা পুলিশ সহায়তা করে বলে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ।

বুধবার দুপুরে ৪৬/এ নম্বরের বাসার চারতলায় গিয়ে সেই অফিসের সন্ধান পাওয়া যায়নি। সেই সময় ভবনের মালিক সাহাদাত হোসেন বলেন, ‘কে কখন ভাড়া নেয় সেটা তো বলতে পারব না, তবে এ নামে কেউ কখনো ভাড়া নেয়নি।’

অনুসন্ধানে জানা গেছে, তানজিলা নিজেকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পরিচয় দেন। কখনো মানবাধিকার কর্মী আবার কখনো হিসাবরক্ষকও দাবি করেন। কখনোবা মালিকের স্ত্রী ও ব্যক্তিগত পিএস পরিচয় দিত। এর আগেও অনেক জায়গায় সে ও তার দলের লোকজন এ কাজগুলো করেছে। তার প্রতারণার বিষয়গুলো পরিবারও জানে।

রোমানিয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে দুই লাখ টাকা জমা দিয়েছিলেন পিরোজপুরের লিটন হাওলাদার। কিন্তু সেই টাকা খোয়া যাওয়ায় বড় বিপদে আছেন তিনি। সেই থেকে এখনো তিনি লজ্জায় গ্রামে যাননি।

আর বহু কষ্টে জমি বিক্রি করে আর ধারকর্য ও সুদে নেওয়া ঋণ এখন পরিশোধ করছেন উত্তরায় গার্মেন্টসে চাকরি করে।

লিটন হাওলাদার বলেন, ‘কল্পনাও করতে পারিনি টাকা মাইর যাইবো। এর আগে ২০০৯ সালে রোমানিয়া গিয়েছিলাম। ভাবছিলাম আবারও যাবো কিন্তু এভাবে প্রতারিত হবো কল্পাতীত।’

লিটন হাওলাদারের মতোই রোমানিয়ার স্বপ্নে বিভোর ছিলেন মামুন, সুজয় নাগ, পিন্টু ও রাসেলসহ ৪৬ যুবক।

ভুক্তভোগীদের মধ্যে একজনের বড় ভাই সাইফুল ইসলাম প্রিয়.কমকে বলেন, ‘আমার ছোট ভাই ও তার এক বন্ধুরে বিদেশ পাঠানোর জন্য আমরা দুই লাখ করে চার লাখ টাকা দিয়েছিলাম। কিন্তু তারা বিদেশও পাঠায়নি আর টাকাও ফেরত দেয়নি। তবে অনেক কষ্টে ওই অফিসের হিসাব রক্ষক তানজিলারে বিমানবন্দর এলাকায় ধরে পুলিশে দিয়েছি। তারপরও পুলিশ তাকে আটক করতে চায়নি পরে মামলার ওয়ারেন্ট দেখানোর পর আটক করে পল্টন থানা পুলিশের কাছে সোপর্দ করেছে। এর আগে তো পুলিশ পারলে আমারে উল্টা হাজতে ঢুকায় এমন একটা অবস্থা।’

পাবনার ভুক্তভোগী যুবক রাসেল আহমেদ জানান, তিনি দিয়েছিলেন চার লাখ টাকা। সেই টাকা ফেরত না পাওয়ায় পথে বসেছেন তিনি। নিজের জমি ও ঋণ করে টাকা নিয়েছিলেন। কিন্তু এখনো সেই টাকা পরিশোধ করছেন তিনি।

পল্টন থানার এসআই ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সাইদুল ইসলাম জানান, ‘পুলিশ তদন্ত করে কয়েক মাস আগে পাঁচজনের নামে আদালতে চার্জশিট প্রদান করেছে। তানজিলাসহ দুজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকিরা পলাতক রয়েছে। তাদের একজন বিদেশে ও দেশে থাকেন এ কারণে তার অবস্থান সনাক্ত করা যাচ্ছে না।’

প্রতিষ্ঠান দুটি ৪৬ ব্যক্তি ছাড়াও আরও শতাধিক ব্যক্তিকে চাকরি দেওয়ার নাম করে প্রায় চার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলেও জানান সাইদুল।

তিনি প্রিয়.কমকে বলেন, ‘ভুক্তভোগীদের একজন থানায় অভিযোগ করার পর আমরা বিষয়টির সত্যতা পেয়েছি এবং প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে জড়িত পাঁচজনের নামে আদালতে চার্জ শিট প্রদান করা হয়েছে।’

জানা গেছে, পল্টন থানার মামলাটির সূত্র ধরে তদন্তে নেমেছে সিআইডির একটি টিম। তারাও ঘটনার সত্যতা পেয়েছেন এবং গ্রেফতারকৃত তানজিলাসহ সকলের জবানবন্দী নেওয়া হয়েছে। আগামী ৮ এপ্রিল, রবিবার তাদের আবারও আদালতে তোলা হতে পারে।

Sharing is caring!

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

বিজ্ঞাপন

আর্কাইভ

সর্বশেষ খবর

………………………..