চক্রের মূল হোতা বা সদস্যদের মধ্যে আছেন কতিপয় রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, পুলিশ সদস্য, ব্যাংক কর্মকর্তা, কুরিয়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা, সিএন্ডএফ এজেন্ট এবং ইমিগ্রেশনের একশ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারী। অপরাধীরা এজেন্ট এবং সাব-এজেন্টের মাধ্যমে টাকা ও বিদেশি মুদ্রা ভারতসহ বিভিন্ন দেশে পাচার করছে। ওই টাকার একটি বড় অংশ দিয়ে কেনা হচ্ছে আগ্নেয়াস্ত্র ও বিস্ফোরক। আর এসব অস্ত্র জঙ্গিদের হাতে চলে গিয়ে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে বলে সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরের অভিমত।
সংশ্লিষ্ট সূত্র যুগান্তরকে জানিয়েছে, একটি বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থা সারা দেশে মাঠ পর্যায়ে তদন্ত করে চোরাকারবারি, মুদ্রা পাচারকারী ও হুন্ডি ব্যবসায়ীদের তালিকা প্রস্তুত করেছে। সেই তালিকা জমা পড়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে তালিকাটি দেয়া হয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সেটি গত সপ্তাহে যায় পুলিশ সদর দফতরে। এরপর তালিকা অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করে তা পুলিশ সদর দফতরকে অবগত করতে বৃহস্পতিবার সারা দেশের এসপিদের কাছে চিঠি দেয়া হয়েছে। যাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে তাদের তালিকাও যুক্ত করে দেয়া হয়েছে চিঠিতে।
তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, চোরাকারবারি, হুন্ডি ব্যবসায়ী ও মুদ্রা পাচারকারী চক্রের সদস্যরা চট্টগ্রাম বিভাগে সবচেয়ে বেশি সক্রিয়। এই বিভাগে তাদের সংখ্যা ১৬৭ জন। তাদের মধ্যে কক্সবাজার জেলায়ই আছে ৬১ জন। সিলেট বিভাগে তাদের তৎপরতা সবচেয়ে কম। এই বিভাগে তাদের সংখ্যা ৪২ জন। তাছাড়া ঢাকা বিভাগে (ময়মনসিংহসহ) ৮২, রাজশাহীতে ৯২, রংপুরে ৮১, বরিশালে ৪৭ এবং খুলনা বিভাগে এ চক্রের ১০৯ জন গডফাদার বা সিন্ডিকেট সদস্য সক্রিয় আছে।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনে মুদ্রা পাচারকারী, চোরাকারবারি এবং হুন্ডি ব্যবসায়ী চক্রের মূল হোতা বা প্রধানদের যে তালিকা করা হয়েছে তাদের মধ্যে ময়মনসিংহে রয়েছেন- ধোবাউড়া উপজেলা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক ডেবিড রানা চিসিম, হালুয়াঘাটের ভুবনকুড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সুরুজ মিয়া, ধোবাউড়ার ব্যবসায়ী বুলবুল এবং আবু সালেহ টিপু। এদের মধ্যে বুলবুলের বাড়ি ভালুকাপাড়া এবং টিপুর বাড়ি চারুয়াপাড়া গ্রামে। শেরপুরের সিন্ডিকেট প্রধানরা হলেন- শেরপুর শহরের কাপড় ব্যবসায়ী দিলীপ পোদ্দার, শ্রীবরদীর কাঠ ও গরু ব্যবসায়ী আবু জাফর ওরফে বাচ্চা গেল্লা, আবদুর রহিম ইব্রাহিম, আলমাস ওরফে বাদুর, আবদুর রশিদ এবং জহুরুল হক মেম্বার। নরসিংদীর মুদ্রা পাচারকারী দলের প্রধান হলেন নিজাম উদ্দিন ভূঁইয়া লিটন। তিনি একজন কাপড় ব্যবসায়ী। ব্যবসার আড়ালে তিনি টাকা পাচার করেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করে বলা হয়, মাধবদী বাজারে ‘রমনী ফ্যাশন’ নামে তার একটি প্রতিষ্ঠান আছে।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নারায়ণগঞ্জে মুদ্রা পাচারকারী দলের দুটি গ্রুপ রয়েছে। গ্রুপ দুটির একটির প্রধান হলেন- এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক প্রবীর সাহা। অপর গ্রুপটির নেতৃত্বে আছেন পূবারী সল্ট ইন্ডাস্ট্রিজের স্বত্বাধিকারী পরিতোষ সাহা।
এ বিষয়ে এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক শুক্রবার বিকালে যুগান্তরকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন সব সময় আমার কাছেই থাকেন। যদি আমার বিরুদ্ধে মুদ্রা পাচারের অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া যেত তাহলে নিশ্চয়ই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিত।’ তিনি আরও বলেন, ‘কেউ মুদ্রা পাচারের প্রমাণ দিতে পারলে তাকে ওই পরিমাণ টাকা দিয়ে দেব।’
প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাজশাহী জেলার সিন্ডিকেট প্রধানরা হলেন- শিবগঞ্জের মেসার্স রিফাত ট্রেডার্সের মালিক তোজাম্মেল হক এবং রাজপাড়া থানার ব্যবসায়ী মুকুল হোসেন।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের সিন্ডিকেট প্রধানরা হলেন- আমদানিকারক আবু তালেব, রফিকুল ইসলাম ওরফে চাইনিজ রফিক, বাস মালিক মিন্টু, গরু ব্যবসায়ী আনারুল, কাপড় ব্যবসায়ী গোলাম জাকারিয়া ভদ্র, ধান ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম, পানের দোকানদার মো. সাজু এবং সাবেক ইউপি সদস্য আশরাফুল ইসলাম।
জয়পুরহাটের সিন্ডিকেট গডফাদাররা হলেন- রাশিদুল ইসলাম, আবদুল মালেক ওরফে ফাটা বাবু এবং আবুল হোসেন। এদের মধ্যে সবার বাড়ি জয়পুরহাটের পাঁচবিবিতে। রাশিদুলের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ফাহান ট্রেডাসের্র অবস্থান দিনাজপুরের হাকিমপুরে। অপর দু’জন হাকিমপুরের হিলি স্থলবন্দরে এলসি ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত।
দিনাজপুরের মূল হোতারা হলেন- হাকিমপুর উত্তর বাসুদেবপুরে অবস্থিত সততা বাণিজ্যালয়ের স্বত্বাধিকারী বাবুল রহমান, একই এলাকার সেবা বাণিজ্যালয়ের স্বত্বাধিকারী সাইফুল ইসলাম, পেঁয়াজ ব্যবসায়ী মমতাজ ওরফে মন্তাজ, দক্ষিণ বাসুদেবপুরের আবদুর রশিদ, চেরাডাঙ্গী মহরমপুর গ্রামের আবদুস সাত্তার, আবদুস সামাদ, মোসাদ্দেক এবং শেরেকুল।
ঠাকুরগাঁওয়ের সিন্ডিকেট প্রধানরা হলেন- বালিয়াডাঙ্গী আমজানখোর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. আকালু এবং ওই ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক লাজিব উদ্দিন কাঠলু।
চট্টগ্রামের দুই মূল হোতা হলেন- চট্টগ্রাম মহানগর রিয়াজউদ্দিন বাজারের গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী ও আবুল ফয়েজ। দু’জনের গ্রামের বাড়িই হাটহাজারী উপজেলায়।
কুমিল্লার মূল হোতারা হলেন- কোতোয়ালি চবকবাজার কাপুড়িয়া পট্টির বস্ত্র ব্যবসায়ী বিবেক চন্দ্র সাহা, চৌদ্দগ্রামের স্বর্ণ চোরাচালান ব্যবসায়ী মো. জসিম, বিবিরবাজার রাজমঙ্গলপুরের বেভারেজ এজেন্ট আনোয়ার হোসেন তালুকদার, পোলট্রি ব্যবসায়ী শাহজাহান তালুকদার এবং হুন্ডি ব্যবসায়ী মো. আলমগীর।
গোয়েন্দা প্রতিবেদন অনুযায়ী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সিন্ডিকেট প্রধানরা হলেন- বিষ্ণুপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যন জামাল উদ্দিন ভূঁইয়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি মাসুম বিল্লহ, জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল বারী মন্টু এবং যুবলীগ কর্মী আসাদুজ্জামান রাফি। চাঁদপুরের মুদ্রা পাচার চক্রের সিন্ডিকেট প্রধানের নাম হিসেবে চাঁদপুর চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি সুভাষ চন্দ্র রায়ের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এর বাইরে হাজীগঞ্জের শ্রীপুর গ্রামের আবু ইউসুফের নাম তালিকায় রয়েছে।
এ বিষয়ে সুভাষ চন্দ্র রায়ের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। এমনকি তার মুঠোফোনে এসএমএস পাঠানো হলেও সাড়া মেলেনি। নোয়াখালী জেলার এসপির কাছে পুলিশ সদর দফতর থেকে যে চিঠি পাঠানো হয়েছে তাতে ৮ জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
এর মধ্যে সিন্ডিকেট প্রধান হলেন- চৌমুহুনী পৌর এলাকায় অবস্থিত আমিশাপাড়া স্টোরের স্বত্বাধিকারী। তার গ্রামের বাড়ি সেনবাগের ইয়ারপুরে।
কক্সবাজারের মূল হোতারা হলেন- টেকনাফ পৌর এলাকার মধ্যম জালিয়াপাড়া এলাকার জাফর আলম ওরফে টিটি জাফর, একই এলাকার খুরশিদ, আবু তাহের, মিয়ানমারের নাগরিক কুলালপাড়া গামের মো. আলী, মিয়ানমারের হুন্ডি ব্যবসায়ী নুরুল আমিন।
ভোলার মূল হোতারা হলেন- চকবাজার ফলপট্টি মোড়ের রেনুকা বস্ত্রালায়ের অসীম সাহা, সদর রোডের দে মেডিকেল ফার্মেসির অরবিন্দু দে, কে-জাহান মার্কেট সুবর্ণা জুয়েলার্সের শ্রী মনা চন্দ্র মণ্ডল, সদর রোডের হীরা জুয়েলার্সের আবিনাস নন্দি, কর্মকার ফার্মেসির মিন্টু লাল কর্মকার, নিউ রাজলক্ষ্মী জুয়েলার্সের শ্যামল চন্দ্র মণ্ডল এবং বিক্রমপুর জুয়েলার্সের বিক্রম চন্দ্র মণ্ডল। খুলনার মুদ্রা পাচার চক্রের গডফাদার হিসেবে নাসির উদ্দিন এবং মফিজুর রহমান ঘেনার নাম উল্লেখ করা হয়েছে। তারা দু’জনই পুটখালী সীমান্ত এলাকায় দুটি সিন্ডিকেটের প্রধান হিসেবে কাজ করেন বলে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী সাতক্ষীরার মূল হোতারা হলেন- ভোমরা সিএন্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আলহাজ কাজী নওশাদ দিলওয়ার রাজু, সাতক্ষীরা জেলা পরিষদ সদস্য আল ফেরদৌস আলফা, বৈকারী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান ওরফে আলসে, সাবেক চেয়ারম্যান আবদুর রউফ, বোমরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ইসরাইল গাজী এবং সোনাবাড়িয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মনিরুল ইসলাম।
সিলেটের সিন্ডিকেট প্রধানরা হলেন- জকিগঞ্জের ব্যবসায়ী মুক্তাদির আহমেদ শামীম এবং কানাইঘাটের পাথর ব্যবসায়ী হারিছ আলী।
মৌলভীবাজারের চক্রের প্রধানরা হলেন- উত্তর মুলায়েম এলাকায় অবস্থিত সাদিয়া লাইব্রেরির স্বত্বাধিকারী বাচ্চু মিয়া, বনশ্রী আবাসিক এলাকার এমবি বিপণিবিতানের মালিক ডা. আবদুল আহাদ, সাইফুর রহমান রোডে অবস্থিত শাহ মোস্তফা টাওয়ারের স্বত্বাধিকারী মুহাইমিন এবং ফ্লেক্সিলোড-বিকাশ ব্যবসায়ী মো. শামীম।
এছাড়া সুনামগঞ্জের এসপিকে পাচারকারী চক্রের ১২ জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। এদের মধ্যে মূল হোতা হলেন- তাহিরপুর কয়লা আমদানি গ্রুপের সভাপতি আলকাছ উদ্দিন খন্দকার এবং ওই গ্রুপের আন্তর্জাতিক সম্পাদক ও শাহজালাল এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী আবুল খায়ের।
জানতে চাইলে পুলিশ সদর দফতরের এআইজি সহেলী ফেরদৌস শুক্রবার সন্ধ্যায় বলেন, এ বিষয়ে আমি বিস্তারিত জানি না। খোঁজ নিয়ে বলতে হবে। তবে মন্ত্রণালয় থেকে যদি তালিকা এসে থাকে তবে নিশ্চয়ই সে অনুযায়ী যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। সূত্র : যুগান্তর