‘বিপদনাশিনী দেবী’র অপচিকিৎসার বলি ৪ বছরের শিশু

প্রকাশিত: ১১:৪১ পূর্বাহ্ণ, মার্চ ২১, ২০১৮

ক্রাইম সিলেট ডেস্ক : লালসালু উপন্যাসের প্রতিচ্ছবি বারবার ফিরে আসে ভিন্ন ভিন্ন নামে। আর চিরাচরিত ভাবে এর শিকার হন সমাজের পিছিয়ে পড়া অসচেতন জনগোষ্ঠী। সমাজের বিরাট একটি অংশ বিজ্ঞান থেকে দুরে থাকায় তার সুযোগ নিচ্ছে একটি প্রতারক গোষ্ঠী। বিভিন্ন ভাবে ধর্মীয় মোড়কে তারা তাদের স্বার্থ বাস্তবায়ন করে গেছে। এমনই একটি লালসালুর প্রতিচ্ছবি দেখা গেছে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল শহরতলীর উত্তর ভাড়াউড়া জেটিরোড এলাকায়।

ধর্মের নাম ভাঙ্গিয়ে আধ্যাত্মিক চিকিৎসার দিচ্ছেন মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের শিপ্রা রানী দেব (৪৫)। নিজেকে তিনি হিন্দু ধর্মীয় দেবী ‘বিপদনাশিনী’ দাবী করেন। তার এই দাবীতে অনেক সহজ সরল মানুষ বিশেষ করে মহিলারা বিভ্রান্ত হচ্ছেন। হারাচ্ছেন মূল্যবান জীবন এবং টাকা পয়সা। ধর্মের নামে প্রলোভন দেখিয়ে প্রতারণা করে আসছে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের এই নারী।

তার অপচিকিৎসার ফাঁদে পরে ৪ বছরের এক শিশু মারা যাওয়ার অভিযোগ করেছেন কমলগঞ্জ উপজেলার গোপাল নগর এলাকার বিশ্বজিৎ ঘোষ। শ্রীমঙ্গল থানায় এরই মধ্যে রাশনা বেগম নামে লিখিত অভিযোগ করেছেন।

জানা যায়, নিজ এলাকা এবং আশেপাশে মানুষদের মধ্যে শিপ্রা রানী দেব এবং তার সহযোগী চক্র কৌশলে প্রচার করতে থাকে শিপ্রা রানী দেব হিন্দু ধর্মীয় বিপদনাশিনী দেবীর আশীর্বাদ পেয়েছেন তার কাছে গেলে যেকোনো বিপদ থেকে তিনি রক্ষা করতে পারবেন। এলাকায় বিপদনাশিনী আশ্রয় করেছেন এই ব্যাপারটা খুব ভালো করেই ছড়িয়ে দিয়েছে তার চক্রের সদস্যরা।

এমন খবর ছড়িয়ে পড়ে আশেপাশে থেকে দূরদূরান্তে আর তাতে সহজ সরল মানুষ, তাদের প্রচারণায় প্রলুব্ধ হয়ে নিজেদের সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যে তার শরণাপন্ন হয় এবং এক বার যে তার কাছে যায় সে আর কখনো শিপ্রা রানীর জাল থেকে বেরুতে পারেনা। বিভিন্ন কৌশলে ধর্মকে ব্যবহার করে সে তার জালে আটকে রাখে। এরই মধ্যে বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে চাঁদা তুলে মন্দির তৈরি করেছে কথিত বিপদনাশিনী নাম ধারী শিপ্রা রানী দেব। তার তৈরি মন্দির এখন প্রতারণার আস্তানা।

প্রতিদিন তার কাছে আসছেন নতুন নতুন মানুষ নতুন নতুন সমস্যা নিয়ে। তিনি স্বল্প বসনা হয়ে তার বাড়িতে উপস্থিত লোকদের সামনে অবলীলায় নাচতে থাকেন। যখন নাচতে থাকেন তখন তার চক্রের লোকেরা উপস্থিত সহজ সরল মানুষদেরকে বলেন এই যে বিপদনাশিনী তার উপর আশ্রয় গ্রহণ করেছে। তখন উপস্থিত সহজ সরল মানুষ তার কাছে বিভিন্ন ধরনের সাহায্য চায় প্রতিকারের আশায় সেও সব কিছুর সমাধানের আশ্বাস দেয় এবং ভাব ভঙ্গি সবকিছুতেই নিজেকে তখন এই পৃথিবীর বাইরের কেউ হিসেবে প্রকাশ করে কৌশলে।

জানা যায়, গত ২০ ফেব্রুয়ারি বৃদ্ধি রাণী ঘোষ নামের কমলগঞ্জ উপজেলার গোপালনগর এলাকার ৪ বছরের একটি শিশু বৃদ্ধি মারা গেছে।

মেয়েটির বাবা বিশ্বজিৎ ঘোষ জানান, শিপ্রা রানী কারণে তার মেয়ের লাশ কাঁধে নিতে হয়েছে। তিনি অভিযোগ করে বলেন, “আমার ধর্মীয় আবেগকে পুঁজি করে তারা আমার মেয়েকে মেরেছে, চিকিৎসার নামে অপচিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।

তিনি জানান, অনেক দিন যাবত অসুস্থ মেয়ের চিকিৎসা করিয়েছেন তার মেয়ে বৃদ্ধি রাণী ঘোষ চোখের রোগে ভুগছিল।

মৌলভীবাজার বি এন এস বি চক্ষু হাসপাতাল এবং জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ডাক্তার খায়ের আহমেদ চৌধুরী তার চিকিৎসা করেছিলেন। ডাক্তার রোগিণীর চক্ষু অস্ত্রোপচার এর জন্য মতামত ব্যক্ত করেন এবং ইস্পাহানী ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালে রেফার্ড করেন।

কিন্তু তিনি এই চক্রের অন্যতম সদস্য শিপ্রার কথিত পালক পুত্র শ্রীকান্তের কাছে জানতে পারেন আধ্যাত্মিক চিকিৎসায় বিপদনাশিনী তার মেয়েকে সুস্থ করে দেবেন। কথা শুনে দ্রুত মেয়েকে সুস্থ করার ইচ্ছায় শ্রীমঙ্গলস্থ শিপ্রা রাণী ঘোষের দ্বারস্থ হন। এতে কথিত ‘বিপদনাশিনী’ শিপ্রা রাণী ও তার ছেলেসহ চক্রের লোকজন তাকে ৩ মাসের মধ্যে মেয়ের আরোগ্য হবে এরূপ আশ্বাস দেন।

ছোট্ট মেয়েকে চিকিৎসার বিধি অনুযায়ী শিপ্রা রাণীর আশ্রমে রেখে আসা হয়। কিছুদিন পর মেয়ের কোন উন্নতি না হওয়ায়, উন্নত ও সুচিকিৎসার জন্য নিতে চাইলে ধর্মীয় বিধি-নিষেধ আছে ও দেবী আশ্রয় করেছেন, তার আরোগ্য হওয়া শুরু হয়েছে ইত্যাদি বলে কালক্ষেপণ করে। বিভিন্ন অজুহাতে এরই মধ্যে চিকিৎসার নাম করে এক লক্ষ পঁয়ষট্টি হাজার টাকা নিয়ে যায়। শিপ্রা রানীর বাড়িতে থাকা অবস্থায় গত ২০ ফেব্রুয়ারি শিশু বৃদ্ধি মারা যায়।

শ্রীমঙ্গল থানা তদন্তাধীন অন্য আরেকটি অভিযোগ সম্পর্কে জানা যায়, শিপ্রা রানীর অপচিকিৎসার শিকার হয়ে এরই মধ্যে রাশনা বেগম নামে একজন সিলেটে চিকিৎসা নিচ্ছেন। চিকিৎসার জন্য শিপ্রা রানীর কাছে এলে রাশনা বেগমকে আধ্যাত্মিক চিকিৎসার নামে উপর্যুপরি আঘাত করে এবং এক পর্যায়ে রোগিণীর রক্ত বের হতে থাকে। এ পর্যায়ে তিনি শিপ্রা রাণীর বিরুদ্ধে শ্রীমঙ্গল থানায় অভিযোগ দায়ের করেন।

স্থানীয় লোকদের সাথে কথা বলে জানা যায় শিপ্রা রাণী বীমা কোম্পানিতে চাকুরী করতেন। মন্দির নির্মাণের পর চাকুরী ছেড়ে তিনি নিজেই নিজেকে ‘বিপদনাশিনী দেবী’ আখ্যায়িত করেন। এলাকার জানাজানি হলে অনেকেই ধর্মকে ব্যবহার করে তার এসব কাজের বিরোধিতা করেন।

কেউ কেউ আবার, বিপদনাশিনীর আশ্রয় ভেবে নিজেদের সমস্যা নিয়ে তার বাড়িতে ছুটে যান। সেখানে তার সহচর হিসেবে কাজ করেন কয়েকজন যুবক।

এলাকাবাসীর অনেকেই বলেন, এখানে মন্দির হয়েছে আমরা জানি। মন্দিরে পূজা পার্বণ হবে । কিন্তু শিপ্রা রাণীর মন্দিরে অশ্লীল নৃত্য আর অপচিকিৎসা চলে হরদম। যা আমরা মেনে নিতে পারি না বলে সেখানে যাওয়া হয়না।

স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ভানুলাল রায় বলেন, সে প্রতারক, অনেক অভিযোগ শুনতে পাচ্ছি। এখানে এক নারীকে চিকিৎসার নামে পিটানো হয়। সে ধর্মীয় নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে এসব করে যাচ্ছে। হিন্দু ধর্মীয় পূজা বিধির ও রীতির তোয়াক্কা না করে নিজ ফর্মুলায় বিভিন্ন ধর্মীয় কর্মকাণ্ড করেন।

এ বিষয়ে শিপ্রা রানী দেবের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, আমার এখানে মানুষ আসলে আমি ভাল করে দেই। আমার মাঝে দেবী আছেন। অভিযোগের বিষয়টি জানতে চাইলে কথা বলতে চাননি।

মৌলভীবাজারের সিভিল সার্জন সত্যকাম চক্রবর্তী জানান, আমি বিষয়টি শুনেছি, আমি মৌলভীবাজারের রাইরে আছি ফিরেই খবর নেব।  তবে কেউ লিখিত অভিযোগ দিলে সরাসরি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সহজ হয়।

Sharing is caring!

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

বিজ্ঞাপন

আর্কাইভ

March 2018
S S M T W T F
 12
3456789
10111213141516
17181920212223
24252627282930
31  

সর্বশেষ খবর

………………………..