সিলেটের সাবেক ডিআইজি মিজানের স্ত্রী, ‘আমি আরেক জেলে বন্দি’

প্রকাশিত: ৪:১৭ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ৭, ২০১৮

ক্রাইম সিলেট ডেস্ক : ‘আমি ডিআইজি মিজানের ওয়াইফ, মরিয়ম আক্তার ইকো বলছি। ভাইয়া, বছিলার বাসায় আমাকে আটকে রেখেছে ডিআইজি মিজান। প্রচণ্ড প্রেসার দিচ্ছে তদন্ত কমিটির সামনে তার শেখানো কথা বলার জন্য। আবার ঝামেলা করছে। আমার সঙ্গে আপস করার কথা বলে নানাভাবে হুমকি দিচ্ছে। আমার মা এবং একমাত্র ছোট ভাইকে জিম্মি করে আমাকে পুলিশ হেডকোয়ার্টারে নিয়ে মিথ্যা বলতে বাধ্য করেছে। আমি জেল থেকে বেরিয়ে আরেক জেলে বন্দি হয়ে আছি।’

অনেকটা এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলছিলেন মরিয়ম আক্তার ইকো। যিনি বিতর্কিত ডিআইজি এবং ডিএমপির সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার মিজানুর রহমানের দ্বিতীয় স্ত্রী। চার মাস সংসার করার পরও যাকে অস্বীকার করে উদ্দেশ্যমূলক মামলায় কারাগারে পাঠিয়েছিলেন তিনি। এ ঘটনায় ৭ জানুয়ারি যুগান্তরে তথ্যবহুল রিপোর্ট প্রকাশিত হলে দেশজুড়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। ব্যক্তির গুরুতর অপরাধের এ অভিযোগে মিজানুর রহমানকে প্রত্যাহার করে পুলিশ সদর দফতরে সংযুক্ত করা হয়।

শনিবার বিকালে প্রতিবেদকের কাছে একটি অপরিচিত নম্বর থেকে কল আসে। এরপর নিজের পরিচয় দিয়ে ইকো জেল-পরবর্তী আরেক দফা নির্যাতনের বর্ণনা দেন। তিনি জানান, ‘২ জানুয়ারি জেল থেকে ছাড়া পেয়েও আমি মুক্ত হতে পারেননি। মিজান আমাকে ভাড়া বাসায় তুলে এক রকম বন্দি করে রেখেছে। সব ধরনের যোগাযোগ থেকে আমি বিচ্ছিন্ন। এমনকি টেলিভিশনের সংবাদ যাতে দেখতে না পারি সে জন্য বাসার ডিশ কানেকশন বন্ধ করে দিয়েছে। তাই জেল থেকে বের হয়ে এই প্রথম মুঠোফোন হাতে পেয়ে আপনাকে ফোন করছি।’

মরিয়ম আক্তার ইকো ৩ ফেব্রুয়ারি থেকে ৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কয়েক দফা ফোন করে তার বন্দিজীবনের দুঃখ-দুর্দশার কথা তুলে ধরে সহযোগিতা চান। এ সময় ইকো প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমাকে সামাজিকভাবে স্বীকৃতি দেয়ার আশ্বাস দিয়ে ১৭ জানুয়ারি কলাবাগানে একটি জায়গায় নেয়া হয়। কিন্তু সে কথা দিয়ে কথা রাখেনি। বলেছিল, তদন্ত কমিটির কাছে তার পক্ষে সাক্ষ্য দিলে ১ ফেব্রুয়ারি সামাজিকভাবে স্ত্রী পরিচয় দিয়ে নিয়ে যাবে। কিন্তু এখন বলছে ভিন্ন কথা। মিজান বলছে, আমাকে এক সপ্তাহ সময় দাও। এর মধ্যে তুমি কক্সবাজার থেকে ঘুরে আস। ড্রাইভার গিয়াস তোমাকে নিয়ে যাবে। তার স্ত্রীও যাবে। সে বলছে, ৫ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় দফায় পুলিশ সদর দফতরে সাক্ষ্য দেয়ার জন্য তোমার যাওয়ার দরকার নেই। কিন্তু এ প্রস্তাব আমি প্রত্যাখ্যান করায় মিজান সরাসরি কথা বলার জন্য তার ভাগ্নে সাইফুল ও ড্রাইভার গিয়াসকে দিয়ে আমাকে ভিন্ন কোনো স্থানে নিয়ে যেতে চায়। কিন্তু নির্যাতনের ভয়ে আমি যাচ্ছি না।’

ইকো মোবাইল ফোনে গত তিন দিনে প্রতিবেদককে যা বলেছেন তার সারমর্ম হচ্ছে- কারাগারে কোনো এক সাংবাদিক তার (ইকো) সাক্ষাৎকার পেয়ে গেছে এমন খবর জেনে যান ডিআইজি মিজান। এরপর তড়িঘড়ি তাকে জামিনে বের করার ব্যবস্থা করা হয়। এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে কাজীর দায়ের করা মামলাটি আপস-নিষ্পত্তি করে তাকে জেল থেকে মুক্ত করেন। এর আগে ১৮ ডিসেম্বর ডিআইজি মিজানের বাসা ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগে দায়ের করা মামলায় জামিন পান তিনি। ১ জানুয়ারি কাজীর জিম্মায় তাকে জামিন দেয়া হয়। ২ জানুয়ারি কারাগার থেকে বেরিয়েই দেখেন ডিআইজি মিজানের ড্রাইভার গিয়াস উদ্দিন বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন। কারা ফটকের বাইরে অপেক্ষমাণ গাড়ি। এরপর নিয়ে আসা হয় রাজধানীর বছিলার বাসায়। ১ জানুয়ারি লালমাটিয়ার বাসা ছেড়ে দেয়ার কাজটি ডিআইজি মিজান নিজেই করেন। এরপর তাকে রাখার জন্যই বছিলার বাসাটি ভাড়া করা হয়। লালমাটিয়ার বাসার মালামাল এখানে নিয়ে আসা হয়। এখানে এসে দেখেন তার মা ও ভাইকে এ বাসায় জরাজীর্ণ অবস্থায় রাখা হয়েছে। এ সময় স্বাভাবিকভাবেই ভাইবোন ও মায়ের কান্নায় সেখানে পরিবেশ ভারি হয়ে ওঠে। তাদের সান্ত্বনা দেন গিয়াস। এরপর গিয়াস উদ্দিন মায়ের হাতে ইকোকে তুলে দিয়ে ডিএমপি কমিশনারের কাছে দেয়া অভিযোগ প্রত্যাহারের আবেদনপত্রে স্বাক্ষর করতে বলেন। এ সময় বেঁকে বসেন ইকো। বলেন, যে স্বাক্ষরের জন্য তাকে জেলে যেতে হয়েছে আবারও সেই একই স্বাক্ষর! অভিযোগ প্রত্যাহারের এই স্বাক্ষর করা যাবে না। প্রয়োজনে আবারও জেলে যাওয়ার কথা বলেন। তখন ইকোর এ কথায় বাধা দেন কুইন তালুকদার। বলেন, এ স্বাক্ষরের শর্তেই তোমাকে জেল থেকে বের করে আনা হয়েছে। এক হাতে মেয়ে অন্য হাতে অভিযোগ প্রত্যাহারের আবেদনে স্বাক্ষর দেয়া হয়। আবেদন নিয়ে চলে যান ডিআইজি মিজানের বিশ্বস্ত এই গাড়িচালক ও সব ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী গিয়াস উদ্দিন। এরপর তাকে সামাজিক স্বীকৃতি দেয়ার কথা বলে দুই পরিবারের পক্ষ থেকে কয়েক দফা বৈঠকও হয়। উভয় পরিবারের ৮-১০ জন ছিলেন ওই বৈঠকে। ৭ জানুয়ারি যুগান্তরে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশের পর আবারও উত্তেজিত হয়ে ওঠেন ডিআইজি মিজান। ৮ জানুয়ারি বছিলার বাসায় এসে প্রতিবেদনে যা অভিযোগ করা হয়েছে তার সবকিছু প্রত্যাহার করার জন্য প্রকাশ্যে হুমকি দেন। ভয়ে ডিআইজি মিজানের চাকরি রক্ষার স্বার্থে তদন্ত কমিটির সামনে যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু বলার আশ্বাস দেয়া হয়। সাংবাদিকরা এ বাসার ঠিকানা পেয়ে গেলে সরাসরি আসা বন্ধ করে ভিন্ন পথ তালাশ করেন। ড্রাইভার গিয়াস ও তার ভাগিনা সাইফুলকে পাঠিয়ে বাসার বাইরে একান্তে কথা বলার প্রস্তাব পাঠানো হয়। দফায় দফায় তাদেরকে প্রেসার সৃষ্টি করে তদন্ত কমিটির সামনে তার পক্ষে কথা বলতে বাধ্য করেন।

ইকো বলেন, ‘আমার পিতা নেই, বড় কোনো ভাইও নেই। একমাত্র ছোট ভাই একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে পারছে না। ভয়ে ঢাকার বাসা ছেড়ে গ্রামে চলে গেছেন মা। সামাজিক মর্যাদা দেয়ার কথা বলে বছিলার বাসায় রাখা হয়েছে। এটাও আরেকটা জেল। বারবার আমাকে গুলি করে হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছে। বিয়ের পর থেকে যেভাবে নির্যাতনের স্বীকার হচ্ছি, তা কোনো মানুষ সহ্য করতে পারবে না। অথচ আমাকে তালাকও দেয়া হচ্ছে না। আমি সরকার ও পুলিশ বাহিনীর কাছে নিরাপত্তা চাই।’

খাওয়া-দাওয়া কিভাবে হচ্ছে জানতে চাইলে বলেন, ‘কখনও ডিআইজি মিজানের ভাগিনা সাইফুল আবার কখনও ড্রাইভার গিয়াস বাজার করে দিয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে ডিআইজি মিজান খোঁজখবর নিচ্ছেন। তবে আমি বাসা থেকে যাতে বের না হই, সে জন্য কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। বাসার আশপাশে সাদা পোশাকে লোকজন রাখা হয়েছে তা বুঝতে পারছি।’

ইকো বলেন, ‘একদিন গিয়াসকে পাঠাচ্ছে, আরেকদিন ভাগিনাকে পাঠাচ্ছে। আবার দু’জন একসঙ্গে এসে বলছে, স্যারের (ডিআইজি) জীবন আপনার হাতে। আর চাকরি চলে গেলে আপনার স্বীকৃতি দিয়ে কি করবেন? এসব কথা বলে আমাকে ইমোশনালি ব্ল্যাকমেইল করা হচ্ছে।’ এখন তদন্ত কমিটির কাছে সব খুলে বলতে চান কিনা জানতে চাইলে বলেন, ‘হ্যাঁ আমি আবারও তদন্ত কমিটির কাছে যেতে চাই। নির্যাতনের সব কথা বলতে চাই।’

এদিকে তথ্যানুসন্ধানে বছিলার বাসায় পারিবারিকভাবে বৈঠকের একটি অডিও রেকর্ড পাওয়া যায়। সেখানে ডিআইজি মিজানুর রহমানের ড্রাইভার গিয়াস, তার ভাগিনা সাইফুল, ইকোর মা কুইন তালুকদার ও ইকোর কথা শোনা যায়। অডিওতে ডিআইজি মিজানুর রহমানের ভাগিনা সাইফুল ইকোকে মামি সম্বোধন করে বরিশালের আঞ্চলিক ভাষায় বলতে শোনা যায়, সে (ডিআইজি মিজান) যে আচরণ করেছে তার জন্য ক্ষমা চেয়েছে। তার বড় সংসার (প্রথম স্ত্রী) মনে হয় আর টিকবে না। দুই ছেলে নিয়ে হয়তো সে কানাডায় স্থায়ী হবে। মামি এখন এই সময়টা কাজে লাগাতে হবে। সময় যদি কাজে লাগানো না হয় তাহলে সমস্যা। এর আগে গিয়াস ইকোকে ছোট বোনের মতো উল্লেখ করে বলেন, তুমি চল। কোনো সমস্যা হবে না। সে তোমার সঙ্গে একান্তে কথা বলতে চায়। অডিওর কথাবার্তায় স্পষ্ট যে, ড্রাইভার গিয়াস ও সাইফুল ইকোকে বাইরে কোথাও নিয়ে যেতে চাচ্ছেন। কিন্তু মরিয়ম আক্তার ইকো বাইরে যেতে চাচ্ছেন না। এ বিষয়ে ইকো গিয়াস ও সাইফুলকে বলছেন, এখানে যেহেতু গার্ডিয়ানরা ইনভলভ হয়ে গেছে, সেখানে তার (ডিআইজি মিজান) সঙ্গে আমার কোনো কথা নাই। এ পর্যায়ে ইকোর মা কুইন তালুকদার বলেন, ‘শোন গিয়াস আমি একটা কথা বলি, সেটা তাদের হাজবেন্ড ওয়াইফের বিষয়, সেটা আমি জানি না। আগে আমি মার্কেট থেকে বাসায় গেছি কেউ কোনোদিন জিজ্ঞেসও করেনি। এখন তো সেই পরিবেশ শেষ। এখন বাসা থেকে বেরই হতে পারব না। আবেগাপ্লুত হয়ে ইকোকে বলতে শোনা যায়, যেখানে আমার মায়ের সম্মান নেই সেখানে আমার সঙ্গে আর ব্যক্তিগত কথা বলার প্রয়োজন নাই। এর জবাবে গিয়াস বলেন, কান্নাকাটি কইরো না। যা হবার হয়েছে।’ আবারও ইকো বলেন, মিজান বলেছে, আমার চাকরি রক্ষার্থে এইভাবে বলতে হবে, যেভাবে চেয়েছে সেভাবেই বলে দিয়েছি। তারপরও তার ভালো হোক এটা আমরা চাই। আর আমাদের সে যা করে করুক। এ সময় ইকো নানান স্মৃতি মনে করে কাঁদছিলেন। একপর্যায়ে গিয়াস বলেন, সে (ডিআইজি মিজান) বলেছে ওর সঙ্গে আমার কথা বলা দরকার। আমি বলছি, স্যার যদি কথা বলতেন তাহলে এদিকে আসেন। তখন তিনি বলেন, ওই বাসায় যাওয়া এখন ঠিক হবে না। আমার বাসায় আসেন। ওখানেই আমি ইকোকে নিয়ে আসতেছি। জবাবে ইকোকে বলতে শোনা যায়, তাকে বলে দিয়েন আপু আর স্বাভাবিক হতে পারবে না। এরপর গিয়াস বলেন, আজকে একটু টেস্ট করে দেখি কি হয়। এরপর ইকো বলেন, দেখা করার কোনো প্রয়োজন নাই সে যেভাবে বলে দিয়েছে সেভাবেই আমি বলে আসব। বাট আপনার স্যার কোনোদিন আমার ছায়াও দেখতে পারবে না। এরপর ইকোর মা বলেন, মিজান যে কথা বলেছে তার কথার বাইরে একটা কথাও বলব না। সেটা ওয়াদা করলাম। এরপর ইকোকে নেয়ার জন্য বারবার অনুরোধ করেন গিয়াস। এরপর ইকো বলেন, আমাকে ফিফটি-ফোরে চালান দেয়া হয়েছে। এই কষ্টের কথা আমি ভুলতে পারছি না। জবাবে গিয়াস আইনের ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, ‘ফিফটি-ফোর কিছু না। সেভেনটি-ফোর ও টোয়েন্টি-নাইন ধারাটি হচ্ছে খারাপ। চল চল আমার ইজ্জতটা রক্ষা কর। সে যদি কোনো শাউট করে তখন দেখবা। শেষ পর্যন্ত ইকোকে আর রাজি করাতে পারেননি।

প্রসঙ্গত, পুলিশ সদর দফতরের অতিরিক্ত আইজিপি (অর্থ) মইনুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয় ১০ জানুয়ারি। মরিয়ম আক্তার ইকো ২১ জানুয়ারি বিকাল ৪টায় তদন্ত কমিটির সামনে এ বিষয়ে সাক্ষ্য দিতে যান। মোহাম্মদ পুরের বছিলার বাসা থেকে ডিআইজি মিজানের ঘনিষ্ঠ লোকজন কীভাবে পুলিশ সদর দফতরে নিয়ে যায় তার বর্ণনাসহ নানা হুমকি-ধমকির বিষয়ে প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলেন।

অভিযোগের বিষয়ে ডিআইজি মিজানুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তার ব্যক্তিগত সেলফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়।
সূত্র-দৈনিক যুগান্তর

Sharing is caring!

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

বিজ্ঞাপন

আর্কাইভ

February 2018
S S M T W T F
 12
3456789
10111213141516
17181920212223
2425262728  

সর্বশেষ খবর

………………………..