সিলেট ১৩ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২৮শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ১০ই জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি
প্রকাশিত: ৫:৫২ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ১৬, ২০১৮
জৈন্তাপুর প্রতিনিধি :: ২০১৪ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর। রাত ২টা। সিলেট-তামাবিল সড়কের পাশ থেকে উদ্ধার করা হয় সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও নিজপাট ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মখলিসুর রহমান দৌলার লাশ। মখলিসুর রহমান একটি সালিশ বৈঠক থেকে ফিরছিলেন। প্রথমে ধারণা করা হয়েছিল, বাড়িতে ফেরার পথে দুর্ঘটনায় তিনি প্রাণ হারিয়েছেন, কিন্তু পরবর্তী সময়ে তার মৃত্যু নিয়ে সন্দেহ দেখা দেয়। মামলা হয়, লাশ তোলা হয় কবর থেকে। কানাঘুষায় হত্যা পরিকল্পনার পেছনে মূল কারিগর হিসেবে উঠে আসে এক আওয়ামী লীগ নেতার নাম। মখলিসুর রহমান ছিলেন ওই নেতার সকল অন্যায় কাজের পথে অন্যতম এক বাঁধা। সে বাধা সরে যাওয়ার পরই মূলত রাজনীতির মাঠে সরব পদচারণা ঘটে লিয়াকত আলীর। উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের ভার পরে তার কাঁধে। ২০১৫ সালে সম্মেলনের পর সে ভার পাকাপোক্ত হয়। লিয়াকত আলীই উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। পাথরভূমি জৈন্তাপুরে অশেষ ক্ষমতাধর হয়ে উঠতে আর কোনো বাঁধা থাকে না লিয়াকত আলীর। জৈন্তাপুরের অভিভাবক এখন লিয়াকত আলীই। লিয়াকত আলীর উত্থানের গল্প সিনেমাকেও হার মানায়। জৈন্তাপুর উপজেলার বাউরভাগ মলি¬ফৌদ গ্রামের অতি দরিদ্র পরিবারের সন্তান। শক্ত-সমর্থ শরীরের অধিকারী যুবক লিয়াকত আলী ১৯৮৬ সালের দিকে পাহারাদার হিসেবে কাজ নেন বাড়ির পাশের বর্ণিবিল, চাডলা বিলসহ কয়েকটি জলমহালে। গ্রামেই জীবন কাটে মাছের পাহারায়। মাঝে মাঝে উপজেলা সদরে যেতে হতো কাজের প্রয়োজনে। তখন পরিচয় হয় আওয়ামী লীগ নেতা মুখলিছুর রহমান দৌলার সঙ্গে। সে সুবাদেই আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গেও পরিচয় ঘটে লিয়াকত আলীর। অনেক নেতাকর্মীর সঙ্গে চেনাজানাও হয়। তবে লিয়াকত আলীর জীবনে টার্নিং পয়েন্ট হয়ে আসে ১৯৯৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন ইমরান আহমদ। তবে খুব একটা স্বস্তিতে ছিলেন না ইমরান আহমদ। নিজের দলেরই বিদ্রোহী প্রার্থী দিলদার হোসেন সেলিম (বর্তমানে বিএনপি নেতা) কাঁপন ধরিয়ে দেন ভোটের মাঠে। জৈন্তাপুর ও গোয়াইনঘাট উপজেলার আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতাদের প্রায় সবাই দিলদার হোসেন সেলিমের পক্ষেই মাঠে ছিলেন। সে দু:সময়ে মখলিসুর রহমান দৌলা ছিলেন ইমরান আহমদের পাশে। তার হাত ধরেই তখন ইমরান আহমদের কাছাকাছি আসেন লিয়াকত আলী। নির্বাচনী প্রচারণায় সব সময় ইমরান আহমদের কাছাকাছি থাকা ও টুকটাক কাজ করে দেয়ার দায়িত্ব পান। তখনই লুঙ্গি ছেড়ে শার্ট প্যান্ট ধরেন তিনি। জীবনের বাঁক বদলের শুরুও তখন থেকেই। নির্বাচনে ইমরান আহমদ হেরে গেলেও লিয়াকত আলী থেকে যান তার ছায়াতেই। পরবর্তীতে উপ-নির্বাচনে ইমরান আহমদ এমপি নির্বাচিত হন। ইতিমধ্যে ইমরান আহমদের বিশ্বস্ততা অর্জন করে নেন লিয়াকত আলী। জৈন্তাপুর থেকে ঢাকার পথে যাত্রা ঘটে লিয়াকত আলীর। গাড়ি ড্রাইভিং শিখে নেয়ায় একসময় ইমরান আহমদের গাড়ি চালানোর দায়িত্বও পান তিনি। ইমরান আহমদের সাদা রঙের স্টেশন ওয়াগন কারটির ড্রাইভিং হুইল লিয়াকত আলীর হাতেই ছিল। এমপির কাছাকাছি থাকায় স্থানীয় আওয়ামী রাজনীতিতে কদর বাড়ে লিয়াকত আলীর। ১৯৯৬ সালে উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদকের দায়িত্বও জুটে যায় তার। ২০০৩ সালে দায়িত্ব পান যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের। ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর উত্থান ঘটে লিয়াকত আলীর। ক্ষমতায় তখন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার। এমপির কাছাকাছি থাকার কারণে প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতারা তাকে আলাদা চোখে দেখতে থাকেন। সুযোগ নেন লিয়াকত আলী, নিজেকে এমপি ইমরান আহমদের ‘খাস লোক’ হিসেবে পরিচয় দিয়ে প্রভাব খাটাতে থাকেন নানা ক্ষেত্রে। নির্বাচন করারও শখ জাগে। ২০০৯ সালে উপজেলা নির্বাচনে জৈন্তাপুর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হন লিয়াকত আলী। তবে দমেননি তিনি। প্রভাব ঠিকই খাটাতে থাকেন। পকেটে ঢুকতে থাকে কাঁচা টাকা। লিয়াকত আলীকে তখন পেয়ে বসে টাকার নেশা। নজর পড়ে ‘টাকার খনি’ হিসেবে পরিচিত পাথর কোয়ারিগুলোর দিকে। কোম্পানীগঞ্জের পাথররাজ্যের ‘নিয়ন্ত্রক’ শামীম আহমদকে নিজের কাছে ভিড়িয়ে মাটির বুক চিরে ‘পাথর উৎসবে’ শামিল হন লিয়াকত আলী। পাথর কোয়ারিগুলোর দখল রাখতে গড়ে তুলেন নিজস্ব বাহিনী। এমপি ও প্রশাসনের নাম ভাঙিয়ে লিয়াকত আলী বোমা মেশিন দিয়ে কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারিতে পাথর উত্তোলন করতে থাকেন। চলে চাঁদাবাজিও। একে একে গোয়াইনঘাটের জাফলং, বিছানাকান্দি, জৈন্তাপুরের শ্রীপুর পাথর কোয়ারির দখলও উঠে আসে লিয়াকত আলীর হাতে। পরিবেশ বিধ্বংসী বোমা মেশিন, অ্যাসকেভেটর নিয়ে নদীর তীর, টিলা ও খাসিয়াদের জুম সব জায়গায় চলতে থাকে পাথর উত্তোলন। কৌশলি লিয়াকত আলী প্রশাসনের নজর থেকে নিজেকে বাঁচাতে ‘পরিবেশ উন্নয়ন ও পুরাকীর্তি সংরক্ষণ কমিটি’ এবং ‘জাফলং পর্যটন উন্নয়ন পরিষদ’ নামে দুটি সংগঠন তৈরি করে পরিবেশকর্মী বনে যান। ১লা নভেম্বর বোমা মেশিন বন্ধে প্রধানমন্ত্রী বরাবরে স্মারকলিপিও প্রদান করেন। এক সময় লিয়াকত আলীর চোখ পড়ে কয়লা ব্যবসায়ও। তামাবিল সীমান্ত দিয়ে কয়লা ব্যবসায় যুক্ত হতে চান তিনি। তবে সিলেট কয়লা আমদানিকারক গ্রুপকে নিয়ন্ত্রণে আনতে না পেরে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের নিয়ে নিজেই গড়ে তোলেন তামাবিল কয়লা ও চুনাপাথর আমদানিকারক গ্রুপ। এরই সূত্রে তামাবিল কাস্টমসেও নিয়ন্ত্রণ তৈরি করেন লিয়াকত আলী। চাঁদাবাজি-দখলবাজি সামলানোর জন্য লিয়াকত আলী তিন উপজেলায় গড়ে তোলেন নিজস্ব বাহিনী। তার অপকর্মের প্রতিবাদ করলে এ বাহিনী অ্যাকশনে নামে। তাতেও কাজ না হলেও মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করা হয় প্রতিবাদকারীদের। এজন্যও লিয়াকত আলীর নিজস্ব সিন্ডিকেট রয়েছে। জাফলং, তামাবিল, ভোলাগঞ্জ ও জৈন্তাপুরের শত শত লোকের নামে এমন মামলা রয়েছে। এসব মামলায় অনেকেই জেল খাটছেন। এমনকি তার অপকর্মের কথা সংবাদপত্রে প্রকাশ করায় লিয়াকত আলীর হাতে নির্যাতিত হয়েছেন একাধিক সাংবাদিক। এত কিছুর পরও লিয়াকত আলীর গুণকীর্তনের অভাব নেই। গুণকীর্তনের জন্য তার নিজস্ব কিছু লোক রয়েছে। আর আছে মানববন্ধনের জন্য বাহিনীও। কোথাও লিয়াকত আলীর বিপক্ষে কিছু হলেই এরা ব্যানার নিয়ে মাঠে নেমে পড়ে। হাতের মুঠোয় কোটি কোটি টাকা, নামে বেনামে প্রচুর সম্পত্তি আর এমপির ‘খাস লোকে’র পরিচয়। নিজের নামে স্কুলের ভবনও আছে। এতসব সাফল্যের দেখা পাওয়ার পর লিয়াকত আলী মনোযোগী হয়ে উঠেন জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট ও কোম্পানীগঞ্জের পুলিশ ও প্রশাসনে প্রভাব খাটাতে। থানা-পুলিশের অনেকেই বশ্যতা মেনে নেন লিয়াকত আলীর। দিনে দিনে লিয়াকত আলীর প্রভাব কেবলই বেড়ে চলেছে। একটি হত্যা মামলার প্রধান আসামি হয়েও তাই তিনি যেন ধরা ছোঁয়ার বাইরে। ৩রা ডিসেম্বর জৈন্তাপুরের শ্রীপুর পাথর কোয়ারির জায়গা দখল নিয়ে লিয়াকত আলী ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি কামাল আহমদের অনুসারীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় নিহত হন হোসেন আহমদ নামের এক প্রবাসী। সে মামলায় প্রধান আসামি লিয়াকত আলী। কিন্তু তিনি দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছেন। লিয়াকত আলী এখন ইমরান আহমদের জন্যই গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছেন। ইমরানের আহমদের ক্লিন ইমেজেও কালো ছাপ টেনে চলেছেন তিনি। ইমরান আহমদও চান না এ ছাপ লেগে থাকুক তার গায়ে। তিনি নির্দেশ দিয়েছেন অপরাধী যেই হোক তাকে আইনের আওতায় আনা হোক।
Sharing is caring!
………………………..
Design and developed by best-bd